যদি আবার কোনোদিন আমাদের একটিবার দেখা হতো

সময়টা ২০১৭ সাল
এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। ধর্ম পরীক্ষা ছিল
সেদিন। রিটেন লেখা শেষ। কিছুক্ষণ পরই
নৈর্ব্যক্তিক
দেওয়া হলো। ৩০ টা নৈর্ব্যক্তিক। সময়ও ৩০ মিনিট।
.
৪ মিনিটে ৪ টা নৈর্ব্যক্তিক পূরণ করলাম। ৫ মিনিটের
মাথায় একটা নৈর্ব্যক্তিক-এ আটকে গেলাম! হঠাৎ কি
মনে করে যেন পাশের এক বন্ধুর আন্সার শীট-
এর দিকে
ঘাড় ঘুরিয়েছি। ঠিক তখনই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব
আমাদের হলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জানালা দিয়ে আমার ঘাড় ঘুরানো
দেখে ফেললেন! সঙ্গে সঙ্গে তিনি হনহন
করে হলের
ভিতর ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে আসলেন আমার
দিকে।
আস্তে করে আমার আন্সার শীট-টা হাতে নিলেন।
তারপর
সেটা নিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর রেখে
দিলেন। আমি
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাত-পা কাঁপাকাঁপি
হয়ে শুরু হয়ে গেছে। হলে দুইজন শিক্ষক গার্ড
দিচ্ছিলেন।
তারা দুজনই আমার অপরিচিত। অন্যকোনো স্কুলের
হবে।
কোন স্কুলের, জানি না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গার্ড
দু’জনকে হুংকার দিয়ে বললেন- ‘খবরদার আমি না আসা
পর্যন্ত এই ছেলেকে শীট দিবেন না!’ বলেই
তিনি আগের
মত হনহন করে রুম থেকে বেড়িয়ে চলে
গেলেন!
.
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভিতর
ধুকপুক
করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। অপেক্ষায়
আছি
ম্যাজিস্ট্রেট কখন আবার আসবে। কখন শীট
পাবো। সময়
বেড়েই যাচ্ছে তরতর করে। ম্যাজিস্ট্রেট আর
আসে না।
আমাকেও আর শীট দেওয়া হয় না। সময় যত
বাড়ছে, সেই
সাথে বেড়ে চলছে আমার বুকের ধুকধুকানি!
.
১০ মিনিট পার হয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট এর আসার
কোনো নাম গন্ধ নেই। দু’জন গার্ড এর মধ্যে
একজন স্যার
দরজা কিঞ্চিৎ সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন,
ম্যাজিস্ট্রেট আসছে কি-না দেখার জন্য। কারণ
ততক্ষণে
২০ মিনিট মিনিট পার হয়ে গেছে। উঁকি দিয়ে
দেখলেন
ওই এড়িয়ার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট এর কোনও চিহ্ন
মাত্র
নেই! আমার বুঝতে বাকি রইলো না, ম্যাজিস্ট্রেট
আজ
আর আসবেন না। ম্যাজিস্ট্রেট না আসলে আমাকে
শীট-ও
দেওয়া হবে না। সামান্য ঘাড় ঘুরানোর শাস্তি যে এতটা
ভয়াবহ হতে পারে, আমার জানা ছিল না। আমার হাতের
তালু ঘামছে। মাথায় ভনভন শব্দ হচ্ছে।
.
আর ৫ মিনিট পর ওয়ার্নিং বেল দিয়ে দিবে। আমি তখন
পুরোপুরি আশা ছেড়ে দিলাম। কারণ এই ৫ মিনিট
থাকতে
শীট দিলেও মাত্র ৫ মিনিটে ২৫ টা নৈর্ব্যক্তিক আমি
সঠিকভাবে পুরণ করতে পারবো না। ফলাফল,
নৈর্ব্যক্তিক
এ ফেইল আসবে। আর নৈর্ব্যক্তিক এ ফেইল আসা
মানে
পুরো সাবজেক্ট ফেইল। আর একটা সাবজেক্ট
ফেইল মানে
‘এসএসসি’ পরীক্ষায় ফেইল! ফেইল করা হয়তো
সাধারণ
ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু সবাই যখন জানবে আমি
ধর্ম পরীক্ষার মত একটা সাবজেক্টে ফেইল
করেছি,
তখন আমি সবাইকে কি জবাব দিবো? মুখই বা দেখাব
কি
করে?
.
আমার ঠিক সেই মুহূর্তের অবস্থা আমি লিখে বা
বলে
বর্ণনা করতে পারব না। মাথার উপর ছাদটা চড়কির মত
ঘুরতেছিল। পুরো পৃথিবীটা একদম তুচ্ছ মনে
হতে লাগলো
আমার। অনেকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি
খেয়াল করলাম আমার চোখ থেকে অঝোরে
পানি পড়তে
শুরু করেছে। আমি কাঁদছি। চাপা কান্না। কোনও শব্দ
হচ্ছে
না। তবে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। চোখের পানি গাল
গড়িয়ে
সেটি গায়ের শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। কারণ ততক্ষণে
ওয়ার্নিং বেল দিয়ে দিয়েছে।
.
.
আমি মাথা নিচু করে আছি। চোখ নাক মুছে হল
থেকে
বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঠিক তখনই আমার
পিঠে একজনের হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম।
ঘটনার শুরু
এখান থেকেই…
আমি মাথা তুলেতেই দেখি সেই স্যারটি! যিনি
ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন কি-না দেখার জন্য বারবার
দরজা
ফাঁকা করে বাইরে উঁকি দিচ্ছিলেন। স্যারের হাতে
আমার আন্সার শীট। স্যার আন্সার শীট-টা আমার
হাতে
দিলেন। তারপর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র টা নিজের
হাতে
নিলেন। বললেন, ‘তোমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়
কে?’
আমি Sabbir কে দেখিয়ে দিলাম। ও আমাদের
হলেই ছিল।
স্যার আমার নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র টা নিয়ে সাব্বিরের
কাছে গেলেন। ওর ততক্ষণে সবগুলো
নৈর্ব্যক্তিক পূরণ
করা শেষ। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। স্যার
সাব্বিরকে বললেন- ‘দ্রুত এই নৈর্ব্যক্তিক গুলোর
সঠিক
উত্তর গুলোর উপর কলম দিয়ে একটা করে
“ডট”দিয়ে
দাও!!’… ও তাই করলো। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্রের
সঠিক
উত্তর গুলোর উপর একটা করে ডট দিয়ে দিলো।
২ মিনিটে।
আর মাত্র ৩ মিনিট বাকি আছে। স্যার এবার প্রশ্নপত্রটি
আমার হাতে এনে দিলেন। তারপর বললেন- ‘দ্রুত
এই ডট
চিহ্ন দেখে দেখে আন্সার শীট-এর বৃত্ত
গুলো ভরাট করে
দাও’
.
আমি ধূমকেতুর গতিতে বৃত্ত ভরাট করা শুরু করলাম।
আমার
হাত কাঁপছে। সবগুলো ভরাট করতে ৬ মিনিটের মত
লেগে
গেল। ভরাট করে মাথা তুলে দেখি প্রায় সবার শীট
জমা
দেওয়া শেষ। পুরো হল-এ আমি একাই বসে আছি।
আর ওই
স্যারটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সবার শেষে আমার শীট জমা নিলেন তিনি। আমি
শীট
জমা দিতে গিয়ে আবারও কেঁদে ফেললাম। এবার
স্যার
আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে,
তার
চোখেও পানি টলমল করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে
এই প্রথম
সম্ভবত একদমই অপরিচিত কোনো ছাত্রের জন্য
কোনো
শিক্ষক চোখের জল ফেললেন। সে জলের
মূল্য কোনোদিন
আমি তাকে দিতে পারবো না। আমি তখনও স্বাভাবিক
হতে পারছি না। হাত পা আমার তখনও কাঁপছে। আমি হল
থেকে বের হয়ে এলাম চোখ মুছতে মুছতে।
শুনতে পেলাম
স্যারের শেষ কথাটা- ভালো থেকো সব সময়।
.
.
তখন আমি ফোন ব্যবহার করতাম না। মোবাইল নাম্বার
রেখে দেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনাও আমার মাথায়
আসে নি। সেই সময় আমার শুধু এটাই মনে
হচ্ছিলো, আমার
সামনে কোনো ফেরেস্তা দাঁড়িয়ে আছে। ইনি
মানুষ হতে
পারেন না। কোনো ভাবেই না। এরকম ফেরেস্তা
পৃথিবীতে একশ’ বছরে একজন জন্মায়।
.
পরের পরীক্ষায় সারা সেন্টারে আমি সেই
স্যারকে তন্ন
তন্ন করে খুঁজলাম, পেলাম না। আজও পাই নি। তার নাম
কি, জানি না। কোন স্কুলের শিক্ষক, তাও জানি না।
জানি না সে কোথায় থাকে। মানুষটা এখন কোথায়
আছে,
কেমন আছে, জানি না কিছুই।
.
এখনও এসএসসি পরীক্ষার সময় আমি আমাদের
এলাকার
প্রতিটা সেন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
কোনও
একদিন সেই মানুষরূপী ফেরেস্তাটার সাথে দেখা
হয়ে
যাবে, সেই আশায়। স্যার…আপনি এখন কোথায়
আছেন?
আপনাকেই আমি খুঁজিয়া বেড়াই।
কোনোভাবে যদি আপনি আমার এই লেখাটা
দেখতেন।
যদি আবার কোনোদিন আমাদের একটিবার দেখা
হতো।
আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো নাহ…..!!