বিয়ে কথন

বিয়ে কথন
লেখক: Riyad Ahmod Bhuiya
.
সুমনাকে একরকম তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে আর সেটাও আবার হুজুর টাইপের এক ছেলের সাথে! সুমনা সবেমাত্র মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হবার অপেক্ষায় ছিল। সাথের বান্ধবীরা প্রায় সবাই যখন ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি ভালো কলেজে ভর্তি হবার স্বপ্ন দেখছে তখনি বলা নেই কওয়া নেই বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল সুমনার। আর এজন্য রীতিমতো নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে।
.
বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার কোন সুযোগ নেই তার। মনের সকল ব্যথা, আশা আর আকাঙ্খার কথা একমাত্র মায়ের কাছেই বলতে পারে সে। বিষয়টি তার বান্ধবী মহলে জানাজানি হবার পর অনেকেই বাসায় দেখা করতে আসে তার সাথে। কেউ কেউ শান্তনা দেয় আবার কেউ শান্তনার ছলে খোঁচাও দিয়ে যায়। এই যেমন; ‘আমাদের মা-বাবা কোন চাপ দেননা, যত খুশি পড়াশোনা করতে পারব’, ‘মেয়ে হয়েছি বলে দোষ হয়েছে নাকি! পড়াশোনা করে চাকরী নিয়ে তারপর নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে সংসার শুরু করব’, ‘আসলে কি বুজলি, তোর না কপালটাই খারাপ, নয়ত এসময়ে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে যায় আবার তাও কিনা একটা হুজুর টাইপের ছেলের সাথে!’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
.
দিনরাত সুমনার দুচোঁখে শুধু পানি আর পানি। কি করবে সে কিছুই বুজতে পারতেছেনা। এভাবে দেখতে দেখতে বিয়ের দিনক্ষণ চলে আসলো। বিয়ের আগের রাতে প্রায় সকল বান্ধবীরাই আসলো সুমনাদের বাসায়। পরদিন সময়মতো বরযাত্রী আসলো। যথাসময়ে কাজী সাহেব আসলেন এবং কাবিননামা লিখা শুরু করলেন। ঝামেলা বাঁধলো দেনমোহর ধার্য করার ক্ষেত্রে। কাজী সাহেব দেনমোহরের বিষয়ে ছেলে পক্ষকে জিজ্ঞেস করলে তারা সেটা ‘তিন লক্ষ টাকা’ ধার্য করতে বলে। এতে না খোশ হয় কনে পক্ষ। তাদের দাবি দেনমোহর ‘দশ লক্ষ টাকা’ ধার্য করতে হবে!
.
একপর্যায়ে বর বাধ্য হয়ে দেনমোহর দশ লক্ষ টাকা করার কারণ জানতে চাইলে কনে পক্ষ থেকে বলা হয়- এত কম টাকা দেনমোহর ধার্য করলে এলাকায় তাদের মানহানী ঘটবে! বেশি ধার্য করলে লোকমুখে এটা ছড়িয়ে পড়বে আর সকলেই এটা নিয়ে মাতামাতি করবে এবং তাতে সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। এতে বর নারাজ হয় এবং দেনমোহর তিন লক্ষ টাকাই ধার্য করার জন্য বলে। অবশেষে সেটাই হয় এবং বিয়ের সকল কাজ সম্পন্ন হয়।
.
সুমনার মনে চাপা কষ্ট। একে তো তার পড়াশোনা বন্ধ হবার উপক্রম সাথে আবার হুজুর টাইপের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে তাও আবার দেনমোহর ধার্য নিয়ে ঝামেলাও হয়েছে। বাকি জীবন তার কি করে কাটবে না কাটবে তা ভাবছে আর বিছানায় বসে বসে চোঁখের পানি ফেলছে। বিয়ে হলে প্রতিটি মেয়ের জীবনেই এই রাতটি আসে যাকে বলে ‘বাসর রাত’!
.
হালকা কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো রুমটি। বরের বোন আর ভাবীরা দলবেঁধে এসেছে এই রাত সম্পর্কে সুমনাকে সলাপরামর্শ দিতে। পরপর সবাই কিনা কি সুমনার কানে কানে বলে তারপর চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রুমে কারোর ঢুকার শব্দ শুনে নড়ে ওঠে সুমনা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে বর (সাদমান) আসছে। বুকের ভেতরে ধপধপ করতে শুরু করে সুমনার। বিছানার কাছে এসে সুমনাকে উদ্দেশ্য করে সাদমান বলে;
-আসসালামুআলাইকুম!
-ওয়া…আলাইকুম… আসসালামমম…. (নিচুস্বরে উত্তর দেয় সুমনা)
-আপনার অজু করা আছে কি?
-নাহ, কেন?
-আপনাকে নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে সালাতুস শোকর (নামাজ) আদায় করব তো তাই।
-ওহ, তাহলে আমি বাইরে থেকে গিয়ে অজু করে আসব কি?
-নাহ, বাইরে যেতে হবেনা। বাথরুমেই অজুর ব্যবস্থা আছে।
-আচ্ছা।
সুমনা এবার বাথরুম থেকে গিয়ে অজু করে আসে।
.
সুমনার জীবনে এর আগে তার মায়ের সাথে শবে বরাতের নামাজ, তারাবীহের নামাজ এবং এরকম বিশেষ বিশেষ সময়ে নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর আজ সে তার স্বামীর সাথে নামাজে দাড়াচ্ছে! সাদমান বলে দিয়েছে, ‘দু’রাকাআত’ নামাজ পড়বেন। তারপর আমরা আল্লাহর দরবারে একসাথে মোনাজাত করব। নামাজ শেষ হয়। মোনাজাতও করা হয়। এবার সুমনাকে বিছানায় গিয়ে বসতে বলে সাদমান।
.
সুমনা বিছানায় বসে আছে। ভাবছে তার অতীত জীবনের কথা। তবে আজকে সাদমানের সাথে নামাজ পড়ে আর মোনাজাত করে সে তার মনে যে প্রশান্তি পাচ্ছে এমনটি তার আগে কখনোই হয়নি। সাদমান আলমারি থেকে একটা সাদা কাগজে মোড়ানো বান্ডেল নিয়ে আসলো।
-এই নিন, এতে পুরো তিন লক্ষ টাকা আছে। এটা আপনার দেনমোহর। আপনার টাকা আপনি বুজে নিন
-আমি টাকা নিব মানে? (অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সুমনা)
-আমি এই টাকাটা আমার স্ত্রীকে বিয়েতে দেনমোহর হিসেবে দিব বলে জমিয়েছিলাম। এখন আপনি আমার স্ত্রী। এটা আমার কাছে আপনার পাওনা তথা, এটি আপনার অধিকার। এটি আপনাকে না দিয়ে আপনার শরীর স্পর্শ করলেও আমার কবীরা গুনাহ হবে।
-এই টাকা দিয়ে আমি কি করব?
-স্ত্রীকে ধার্যকৃত দেনমোহরের অর্থ পরিশোধ করা আল্লাহর বিধান। এখন থেকে এই টাকার উপর আমার কোন অধিকার নেই। এসবই আপনি আপনার খুশিমতো যেকোম খাতে ব্যয় করতে পারেন।
এভাবে স্ত্রী সুমনাকে দেনমোহরের বিষয়ে সাদমান বিস্তারিত বুজিয়ে বলে এবং সুমনাও সেটা বুজতে পারে।
.
এবার সাদমান তার স্ত্রীর সাথে শয়নে যায়। বাসর রাত নিয়ে মেয়েদের মনে একপ্রকার ভয়ের কাজ করে আর সুমনাও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। সাদমান এবার তার সাথে গল্প করা শুরু করে দেয়।
-আচ্ছা, আপনারা কয় ভাইবোন?
-মানে? আপনি কি এসব না জেনে আমাকে বিয়ে করেছেন?
-আরে বলুননা, আপনারা কয় ভাইবোন?
-আমরা দুই ভাই আর এক বোন। (বিরক্তির স্বরে জবাব দেয় সুমনা)
-হুমমম, স্কুলে আপনার রুল কত ছিল?
-কিসব আবোলতাবোল প্রশ্ন করতেছেন! কোন শ্রেণীর রুলের কথা বলব?
-দশম শ্রেণীরটাই বলুন!
-‘নয়’ ছিল।
-বাহ, দারুণ তো! ‘নয়’ তো আমার সবচেয়ে পছন্দের সংখ্যা।
-আপনার প্রিয় রং কি?
-নীল।
-কি বলেন! আমারো তো নীল রং পছন্দ।
-অবসরে আপনার কি করতে ভালো লাগে?
-বই পড়তে।
-সবকিছুই দেখছি মিলে যাচ্ছে! আমারো তো অবসরে বই পড়তে ভালো লাগে।
.
এভাবেই গল্প করতে করতে রাত গভীর হয়ে যায়। ততক্ষণে সাদমানের সাথে কথা বলতে বলতে সুমনার মন থেকে বাসর রাত নিয়ে থাকা ভয়টা কেটে গেছে। আপনি করে বলা থেকে তুমি করে বলায় নেমে আসে দুজনে। সুমনার হাবভাব বুজতে পেরে সাদমান বলে;
-আমি বুজতে পারছি তোমার মনে কি চলতেছে। আসলে, বিয়ের প্রথম রাতেই স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা থেকে বিরত থাকা ভালো। এটি আমি হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) -এর লিখা ‘বেহেশতী জেওর’ নামক বই থেকে শিখেছি। প্রথম রাতে স্ত্রীর সাথে খোশগল্প করাই শ্রেয় বা উত্তম। কারণ, এদিন স্ত্রী তার পরিবার পরিজন সবকিছু ছেড়ে এক নতুন পরিবেশে আসে। এমনিতেই তার মন খারাপ থাকে। তার উপর আবার স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে শারীরিক কিছু করতে যায় হয়ত সে স্বামীকে না করবেনা কিন্তু এটা উচিৎ নয়। তুমি আমাকে ভয় পেওনা বা অন্যকিছু ভেবোনা। আমি তোমার সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়েছি। আল্লাহ্ চাইলে মরণ পর্যন্ত তোমাকে নিয়েই সুখের সংসার করতে চাই।
কথাগুলো শোনার পর মনের অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু ছেড়ে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সুমনা। স্ব জোরে জড়িয়ে ধরে সাদমানকে। আর বলে ওঠে; ‘আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী তোমার মতো স্বামী পেয়ে। আমি সারাজীবন নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসব। তুমিই আমার অলঙ্কার। তুমিই আমার সব। তোমার মাঝেই আমি আমার বেহেশত খুজে পেয়েছি’।
.
.
বিঃ দ্রঃ- লিখাটি আমার কাল্পনিক ভাবনা আর ইসলামিক দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক ধারণা থেকে সৃষ্ট। কোন অসঙ্গতি কারোর নজরে পড়লে দয়া করে আমাকে অবহিত করবেন। সংশোধন করে নিব। ধন্যবাদ।