বিশ টাকা লোড দিয়ে দে তো

বিশ টাকা লোড দিয়ে দে তো!
‘বিশ টাকা লোড দিয়ে দে তো! ‘
দোকানে বসে ওয়েষ্টার্ন বিল হিকক বইটা পড়ছিলাম, তখনই শুনতে পেলাম কন্ঠটা। তাকালাম, দেখলাম ব্যক্তিটা আমার চাচা। বাবার চাচাত ভাই। গ্রামীণফোন এর ফ্লেক্সিলোড খাতা আর কলমটা হাতে নিলাম।
‘ নম্বরটা বলেন।’
‘ একবাররে মোবাইলোত তুলে লোড দে । লেখালেখি বাদ দে। খুব দরকার। বাইজিদের সাথে কথা বলতে হবে! ‘
বাইজিদ ওনার ছেলের নাম। গত বছর এসএসসিতে ফেল করার পর এলাকার বখাটে ছেলেতে পরিনত হয়েছে ছেলেটা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ বাইজিদ বাড়িতে নাই?’
‘ না। কাল রাতে বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে তাও বলে যায় নি।
ঝটপট ফ্লেক্সিলোড দিয়ে দিলাম। আমার সামনেই বাইজিদের নম্বরে ডায়াল করলো চাচা। একবার, দুইবার – তৃতীয় বার রিসিভ হলো। রিসিভ হতেই জানতে চাইলেন, ‘ কোথায় তুই?’
অপর প্রান্ত হতে বাইজিদ কি বললো জানি না, চাচা বললেন, ‘কার সাথে গেছিস? ‘
আবার বললেন, ‘তোর সাথের যারা আছে তাদের ফোন টা দে তো! ‘
‘ ঘুমে? ‘
‘আচ্ছা। টাকা পয়সা সাথে আছে?
‘তুই ঢাকা যাবি বলে যাবি না? তোর চিন্তায় চিন্তায় মোক মরা লাগবে। তুই মোক জ্বলবার জন্যই পৃথিবীত আসছিস। ‘
‘ ঠিক মতন খাওয়া দাওয়া করিস।’
‘রাখি। ‘
কথা শেষ হলো। চাচাকে সন্তুষ্ট মনে হলো না।ছেলের কথা বিশ্বাস করেন নি তার মুখের অভিব্যক্তিই তা বলে দিচ্ছে। জানতে চাইলাম, ‘ চাচা, বাইজিদ কোথায় আছে? কি বললো?’
‘ ঢাকায় গেছে বললো। ঢাকা যাবে তা বলে যাবে না? এখন কোথায় কার সাথে আছে! সে চিন্তায় আমরা মরি! তোর চাচি তো কাল রাত থেকে কিছুই খায় নি! ‘
‘ ঢাকা গেছে তো ভালোই হইছে। বাড়িত শুধু ঘোরাঘুরি করে। ‘
‘ কি জানি, বাবা হ বুঝবি! ছেলে মানুষ করাটা যে কি তা একজান বাপই বোঝে! টাকা টা বিকালে নিস। ‘ বললেন চাচা।
রাত নয়টা। গ্রামের বাজার। গ্রামে রাত নয়টা মানে অনেক রাত। বাজারে মানুষ তেমন নেই। দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাবো বলে বের হতেই আমার পাশের বাড়ির এক ভাই এসে বললো, ‘লোড দিয়ে দে তো। ‘
ফ্লেক্সিলোডের মোবাইল হাতেই ছিল। বললাম, ‘ নম্বরটা বলেন। ‘
ফ্লেক্সিলোড দিয়ে টাকা হাতে নিতেই ভাইটা বললেন, বাইজিদের ঘটনা শুনেছিস?
বললাম, হু, চাচার কাছে সকালে শুনলাম ঢাকা গেছে!
ভাই বললো, তা তো গেছে। খবর কিন্তু সেটা না, কপিলের ব্যাটিক পালে নিয়ে গেইছে!
‘ কহিনুরের সাথে? ‘ অবাক হলাম! এমন হতে পারে কল্পনাও করতে পারি নি!
‘ হু। ‘
কত বয়স দুজনের। একজনের বয়স পনের, অন্যজনের তের কি চৌদ্দ! বয়সটা পড়ালেখা করে নিজেকে গড়ে তোলার। বয়সটা খেলার মাঠে বলের পিছে ছোটার বয়স। বয়সটা বান্ধবীদের সাথে সপ্ন নিয়ে গল্প করার বয়স। তা না, এই বয়সে প্রেম নামক আবেগকেন্দ্রিক একটা সম্পর্কের জালে নিজেদের আটকিয়ে বাড়ি হতে পালালো ওরা! কিন্তু এদের ভবিষ্যৎ কি? এ সম্পর্কটা কতটা যৌক্তিক?
বাবা মায়ের কত সপ্ন ছিল তাদের নিয়ে। তাদের সেই সপ্ন ভেঙে দিয়ে, তাদের মান সম্মানের মুখে ছাই লেপে দিয়ে বাড়ি হতে পালিয়েছে। এরপর? বিয়ে টা তো হওয়া দরকার! সামাজিক স্বীকৃতি তো প্রয়োজন আছে, সেটা কিভাবে পাবে, যেখানে আইন বিবাহের বয়স নির্ধারন করেছে একুশ – আঠার। এর পর আসে সংসার জীবন। ঢাকায় যেখানে গেছে সেখানে নিশ্চই আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু সংসার খরচ? সে কোথা হতে আসবে? একটা পনের বছরের ছেলেকে চাকরি কে দিবে?
অবশেষে দেখা যাচ্ছে, তাদের দুজনকেই ফিরতে হচ্ছে পরিবারের কাছে। কিন্তু তাদের আবেগজাত প্রেমের কারনে দুটো পরিবারের লোক সমাজে মানসম্মান হারিয়েছে ততদিনে।
বাড়িতে রাতে ফিরে দেখি চাচী আমাদের ঘরে মায়ের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখেই উঠে এলো। বললো, ‘ বাবা বাইজিদ কই আছে ওর কাছ হতে শুনে নে তো? আর ওক ক, বাড়িত আসতে। ‘
‘ ওর নম্বরতো আমার কাছে নেই চাচী! ‘ বললাম আমি।
‘ নাই? ‘
‘ না। ‘
চাচী আর কথা বলে না। চুপ করে থাকে। আমি বলি, ‘ চাচী চিন্তা কইরেন না। দুদিন যাক, যেখানেই থাকুক ফিরে আমবে। আসতেই হবে। ‘
‘ তাই যেন হয় বাপ। মনডা কেমন যানি করতাছে । বাড়ি ছাড়ি গেইছে যাক, মাইনসের বেটিক নিয়ে গেইসে। এখন কডে কি হয়, যে দিনকাল! ‘
‘ কিচ্ছু হবে না চাচী। টেনশন করিয়েন না।, ‘ বলি আমি। চাচী চলে যায় ।
এলাকাজুড়ে বেশ কানাকানি, আলোচনা সমালোচনা চললো বেশ কদিন। অথচ যাদের নিয়ে এত সমালোচনা আলোচনা, কানাকানি তাদের খবর নেই! ছেলে মেয়ে দুজনেরই ফোন বন্ধ। যদিও প্রথমদিন বাইজিদের ফোন অন ছিল, ও ওর বাবার সাথে কথাও বলেছে। ওই পর্যন্ত। এর পর হতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন । মেয়ের পরিবার ছেলের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে, তাদের মেয়েকে ফেরত না দিলে তারা থানায় মামলা দিবে। ছেলের পরিবারও বিপদে! নিজের ছেলের খোজ যেখানে তারা পাচ্ছে না, সেখানে মেযের খোজ কি করে দিবে?
খোজ মিললো সাত দিন পর। বাড়িতে খেতে বসেছি, এ সময় চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ পেলাম। খাওয়া হলো না । খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে চাচার বাড়ি গেলাম। চাচী কান্না করছে। চাচার চোখে পানি। বাড়িময় মানুষ । কিছুই বুঝতে পারলাম না।
একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে? চাচী কান্না করছে কেন? বাইজিদ কি ফিরেছে? ‘
‘ না। ‘
‘ তাহলে? ‘
‘ বাইজিদ খুন হয়েছে। ‘
‘কি? কিভাবে? ‘
‘ টাঙ্গাইলে রেললাইনের পাশে ওর লাশ খুজে পেয়েছে ওখানকার লোকজন। তার পর ওর পকেটে মোবাইল ছিল, সেটা হতে বাড়িতে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। ‘
‘ আর কোহিনুর? ‘
‘ সেও মারা গেছে। দুর্বৃত্তরা ওকেও ধর্ষন করে মেরে ফেলে রেখে গেছে ওর সাথেই। ‘
এর পর আর কিছু জানতে চাই না। তবে ভেবে পেলাম না, ওরা গেছে ঢাকা, লাশ টাঙ্গাইলে কি করে?
চাচী কান্না করছে, সে কান্নায় যে ছেলে হারা মাতম, তা যদি বাইজিদ দেখতে পেতো, ভাবি আমি। কোহিনুরদের বাড়িতেও নিশ্চই এখন কান্না করছে ওর মা, বাপ, ভাই, ভাবী! কান্নাকাটি করে অপেক্ষা করছে তাদের মেয়ে ঘরে ফিরবে, কিন্তু সেটা মেয়ে নয়, মেয়ের লাশ।
চাচা ফোনে কথা বলছে। কাকে যেন বলছে, ‘ একটা গাড়ি ঠিক কর। টাঙ্গাইল যেতে হবে লাশ নিতে! ‘ কত সহজেই বললো কথা গুলো। অথচ চোখে পানি।
এই কান্না, এই সন্তান হারানোর মাতম ওরা যদি দেখতো, তবে কি পারতো ঘর ছেড়ে, মায়ের আচল ছেড়ে দুরে পালাতে? পারতো কি এ ভুল করতে। তাদের ভুলেই আজ প্রান হারাতে হয়েছে তাদের । আর পরিবার হারিয়েছে তাদের সন্তান।
লেখা: নুর আলম সিদ্দিক
( দুটো সম্পূর্ন ভিন্ন ঘটনার যোগফল)