বংশ রক্ষা

বংশ রক্ষা
মামা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন- বাবা শুন, কাহিনী তো একটা হইয়া গেছে রে।। আদিলের বউ তো গলায় ফাঁস নিছে।। ওই বাড়িতে আগেই কিছু জানাইস না, তুই বাপ আগে বাড়িতে আয়।।
আমি ফোন কানে চেপে ধরে আছি, মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না।। শুধু সামনে দাঁড়ানো কিছু মানুষের মুখের দিকে তাকালাম।। ফুলবানুর মা, চাচা, নানী আর তারাবানুর কৌতুহলী চোখ আমাকে বিদ্ধ করছে।।
আমি ফোনে অস্ফুট কণ্ঠে বললাম- আচ্ছা মামা আচ্ছা!!
ফোন কেটে দিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেস্টা করলাম।। আমার কাছে মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে জোর করে গাঁজা খাইয়ে দিয়েছে।। এর আগে দুইবার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গাঁজা খেয়েছিলাম, বার বার সেই কথা মনে হচ্ছে।। গাঁজা খাবার পর বন্ধু মল্লিক বলেছিলো, শুন একদম স্বাভাবিক থাক, নো হাসি, নো ঢলাঢলি, কেউ যেনো কিচ্ছু না বুঝে।। আমি নাকি ওর কমান্ড শুনে রোবট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।। তাই দেখে মল্লিক হাসতে হাসতে বলেছিলো- বেটা তোরে দেইখা এখন অরজিনাল গাঞ্জুট্টির মত লাগতাছে।। ভাই, তোর যা করতে মন চায় তাই কর- তাও এমনে সিকটা লাইগা থাকিস না।।
ঠিক তেমনি আমি রোবট হয়ে গেছি, আমার ধারণা প্রচন্ড বাতাসের তোড় এলেও আমাকে এখন টলাতে পারবে না।। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আমার অস্বাভাবিকতা ধরে ফেলেছে কিনা এখনো নিশ্চিত না।। আমি ভেবে দেখলাম, খানিক আগে এই বাড়িতে এসেছি, এখুনি যাওয়ার নাম নেয়া যাবে না।। নিলেই নিশ্চিত যেতে দিবে না, অযাচিত সন্দেহ করবে।। আর তারাবানু তো আমার অনুকূলে আছেই।। আমি উনাদের কৌতুহলী চোখের জবাবে শুধু বললাম-
আরে মামা কল দিছিলো, জিগাইলো আমরা পৌঁছাইছি কিনা
সবাই স্বাভাবিক নড়নচড়ন শুরু করে দিলো।। আদিলের শ্বাশুড়ি আমাকে বাবা বাবা বলে ডেকে খুব আদর যত্ন করছে, অথচ আমি কল্পনা করতে পারছি না- কখনো না কখনো তো শুনবেই তার বড় মেয়ে আর দুনিয়াতে নেই, তখন উনার কেমন লাগবে।।
আমি আর কিছু বুঝি না বুঝি, এটা বুঝতেছি যে ফুলবানুকে কেউ মেরে ফেলেছে।। কারণ, পাগল কোনদিন ফাঁস নিতে পারে না, এটা মনে হয় পাগলেও জানে।। আচ্ছা, এমন কি হয়েছে যে বড় মামা আদিলের বউয়ের সাথে অবৈধ কিছু করেছে, বড় মামী এটা জেনে হয়তো আদিলের বউকে মেরে ফেলেছে।। মামা যদি আদিলের বউয়ের সাথে কিছু করে আর মামী যদি সেটা জানে এমন কিছু করা অস্বাভাবিক কিছু না।। আরো অনেকগুলো চিন্তা একসাথে এসে মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে, আপাতত কিছুতেই নিজেকে সামলে নিতে পারছি না।। আমি তারাবানুকে একটু একা পেতে চাইলাম, ওর সাথে কথা বলা দরকার।। কিন্তু, ওদের বাড়িতে ওকে এভাবে এত দ্রুত একা পাওয়া সম্ভব না।। সবার থেকে একটু আলদা হয়ে তারাবানুদের বাড়ির বাইরে গেলাম।।
মামা ফোন দিয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক আগে, অবাক ব্যাপার এরমধ্যে আর কারও ফোন আসে নি।। আমি তারাবানুদের বাড়িতে শরবত, বিস্কুট, চানাচুর এসব খেয়েছি।। এখন বাড়িতে চলে যাবার কথা বলা ঠিক হবে কিনা, ভেবে পাচ্ছি না।। আদিলের শ্বাশুড়িকে দেখলাম, রান্না বান্নায় ব্যস্ত।। দুপুরের রান্নার তোড়জোর চলছে।।
আমি খানিক ভেবে মাসুদকে কল দিলাম, টানা কয়েকবার কল দেয়ার পর মাসুদ ধরলো- ভাই, তুমি কি আইতাছো
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম- না, আসতে মনে হয় দেরি হবে।। আর এই বাড়িতে এখনো খবর জানায় না কেন, পরে জানাইলে তো এরা আরো সন্দেহ করবো।। আর ওই আমারে বল তো, আমি আসার পর আসলে কি হইছে।।
মাসুদ কেমন যেনো আড়ষ্ট, কথায় কোন জোর নেই, আমতা আমতা করে বললো- ভাই, আমি কিছু জানি না।। তুমি তাড়াতাড়ি আহো, এখনো কিন্তু কেউ জানে না, মনে করো আমরা কয়জন ছাড়া বাড়ির আশেপাশের কেউ জানে না।।
আমি বুঝলাম, এখান থেকে ফোনে ফোনে কথা বলে লাভ নেই।। যেভাবেই হোক ঘটনাস্থলে যেতে হবে।। আমি আবার তারাবানুদের বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।। সোজা ওদের রান্নাঘরের দিকে গেলাম, আন্টিকে দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব চিন্তিত মুখাভঙ্গী করে বললাম- আন্টি মাত্র খবর আসছে, আব্বু একটু অসুস্থ, আমাকে আজই ঢাকা যেতে হবে।। মামাবাড়িতে ব্যাগ আছে, আমি এখন ওখানে যাবো।।
আন্টি হায় হায় করে উঠলেন, উনি আমাকে অনেক বুঝাচ্ছেন, তুমি ঢাকা গিয়ে কি করবা, দুপুরে খাইয়া যাও, না খাইলে কষ্ট পামু কত কথা।। আমার বেশ খারাপ লাগছে এই মহিলার জন্যে, সে বাবা ছাড়া আমাকে একবারও ডাকে নাই।। আমি সব মায়া কাটিয়ে ছুটলাম মামা বাড়ি, আমার অনেক অনেক কাজ বাকী।। শুধু স্টার আমাকে বললো- কোন সমস্যা।। আমি বললাম- সব জানবা, ম্যাসেঞ্জারে থাইকো তো!!
আমি সিএনজিতে যাচ্ছি আর মনে হচ্ছে কত দূরের পথ।। আমি যেনো শত যুগ ধরে যাচ্ছি।। আসলে এইসব মুহূর্তে অল্প দূরত্বকেও বিস্তর মনে হয়।। কিছুতেই যেনো রাস্তা ফুরাতে চায় না।। এরমধ্যে তারাবানু আমাকে বার কয়েক কল দিয়েছে, আব্বুর খোঁজ নেয়ার জন্যে।। আমি অবলীলায় মিথ্যে বলে গেছি!!
মামা বাড়ির বাইরে এসে আমি একটু বড় করে শ্বাস নিলাম, তারপর আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকলাম।। কাউকে কোথাও দেখছি না, সব কিছু স্বাভাবিক লাগছে- অথচ ভিতরে ভিতরে না জানি কত কি ঘটে গেছে।। বাড়ির উঠান খাঁ খাঁ করছে।। আমি আগে বড় মামার ঘরে ঢুকতে নিলাম, ঘরের কাছাকাছি এসে শুনলাম একটা চাপা বিলাপের শব্দ।। মামী কাঁদছে হয়তো।। আমি বিষন্ন মনে ঘরে ঢুকলাম।। গিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই সেখানে বসে আছে, কারো মুখে কোন কথা নেই।। আদিলকে শুধু দেখতে পেলাম না, আমার শব্দহীন আচমকা ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে সবাই একটু চমকে গেলো।। মনে হচ্ছে দিন দুপুরে কোন ভূত পায়চারী করে ঘরে হানা দিয়েছে।।
সবাই আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, অথচ আমি নিজেই কোটি প্রশ্ন বহন করে সেই এলাসিন থেকে ছুটে এসেছি।।
আমি একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসলাম।।
বড় মামার দিকে তাকিয়ে বললাম- মামা, আদিলের বউয়ের লাশ কই
মামা মাথা নিচু করে আছে, একটু পর মাথা উঁচু করে বললো – ঐ রুমে আছে।।
আমি একটু চমকে গেলাম, পাশের রুমেই ফুলবানুর লাশ আর সবাই এখানে কি নিরবে বসে আছে।।
আমি এবার বললাম- আচ্ছা, আদিলের বউ কোন রুমে ফাঁস নিছে, লাশ কি নামাইছেন এতক্ষণ ঝুঁইলা থাকলে তো খবর আছে।।
ছোট মামা জবাব দিলো- না লাশ আমরা ধরি নাই।। অই রুমে যেমনে ফাঁস নিছে ওমনেই আছে, খালি বড় ভাবী দরজায় তালা দিছে।। আমরা কেউ বাড়িতে ছিলাম না, তুই আসার একটু আগে আইসা সবাই বসলাম।। কি করমু রে বাবা বুঝতাছি না।।
আমার অদ্ভুত এক কস্ট লাগলো, ফুলির লাশ প্রায় দেড় ঘন্টা যাবত ঝুলে আছে, আমি আর ভাবতে পারছি না, আর আমরা পাশের রুমে বসে খোশগল্পে ব্যস্ত।।
মামাকে আবার প্রশ্ন করলাম- আদিল কই
এবার ছোট মামী জবাব দিলেন- ঐ ঘরে ঘুমায়।। বলে মামী মামার আরেক ঘরের কথা বুঝালো।।
আমি কাকে রেখে, কাকে কি জিজ্ঞেস করবো, এখানে সবাই আমার অতি পরিচিত কিন্তু এখন সবাইকেই অচেনা মনে হচ্ছে।। মনে হচ্ছে আমি একগাদা অপরিচিত লোকের ভীড়ে বসে আছি।। বড় মামীর বিলাপ থেমে গেছে, মাসুদ আর সুইটি একসাথে বসে আছে।। টুইটি ছোট মামীর পাশে বসা।।
ছোট মামা এবার বড় মামাকে বলছে- মিয়া ভাই, তাইলে এহন কি করবেন ফুলি যে একা একা ফাঁস নিছে, এইডা কেউ বিশ্বাস করবো নাকি আর লাশ কতক্ষণ ফালাই রাখবেন কন কিছু একটা তো করা লাগবো, নাকি
বড় মামা বেশ অসহায় ভঙ্গিতে বললো- কি করমু ক, আমারে বুঝা কি করমু।। পুলিশরে ফোন দে ওরা যা খুশি করুক।।
মামার কথা ফুরাতে না ফুরাতেই সাথে সাথে ছোট মামী বলে উঠলো- পুলিশ ডাইকা আগেই কাম নাই।। ফুলবানুগো বাড়িতে ফোন দেন, আফনে ওদের বুঝাইয়া কন, মাইয়ার লাশ আইসা নিয়া যাইক।। পাগল মাইয়ারে ক্যারা মারবো, পাগলের কি শত্রু থাকে, নাকি
আমি বার বার মাসুদের দিকে তাকাচ্ছি, কেনো যেনো ওকে আমার অস্বাভাবিক লাগছে।। আমি উঠে দাঁড়ালাম, ভাবছি একটু ফুলবানুর লাশটা দেখে আসি।। আমার দাঁড়ানো দেখে কয়কজন একসাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, আমি কই যাই।।
আমি কারো কথার কোন জবাব দিলাম না, ঘরের প্রত্যেকটা লোককে আমার সন্দেহ হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই অবুঝ পাগলী মেয়েটাকে তারা সবাই মিলেই হত্যা করেছে।। আমি পাশের রুমের দরজার দিকে তাকালাম, দেখি দরজার কড়ায় তালা দেয়া।।
পরক্ষণেই আমার মাথায় বুদ্ধি এলো, ফুলবানুর লাশ যে রুমে ওই রুমের আরেকটা সিসি ক্যামেরা কাজ করে কিনা চেক দেয়া যেতে পারে।। আইপির মাধ্যমে কানেক্ট করা গেলে তো ভালোই হবে, কিন্তু বারান্দায় রাখা রাউটার অফ করা।। এখানে কেউ ব্যবহার করে না, তাই রাউটার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।।
আমি বাথরুমে যাবার ভান করে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম, আস্তে করে রাউটারে লাইন দিলাম।। উঠানে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ গুঁতাগুতি করে অবশেষে, মোবাইলে আইপি ক্যাম কানেক্ট করতে পারলাম।। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, ওই রুমের ভিতরে ফুলির লাশ কি অবস্থায় আছে দেখার জন্য।। ডিসপ্লে লোডিং হচ্ছে, আমার বুক ঝড়ের মত ধুক্পুক্ ধুক্পুক্ করছে।। মোবাইলের স্ক্রিনে আমি অন্য এক দৃশ্য দেখলাম।। ওই ঘরের মেঝেতে সম্ভবত ফুলির লাশ, বিছানার চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা।। ফ্যানের সাথে একটা ওড়না ঝুলছে।। ফাঁসের ওড়নাই হবে।। অথচ মামা বলেছিলো, লাশ নাকি নামায় নাই।। আমি সত্যি এবার ভীষণ চিন্তায় পড়লাম, এখানে নিশ্চিত কোন বাজে কারসাজি আছে।। মোবাইল লক করে পকেটে পুরে, হেঁটে হেঁটে আদিল যে ঘরে ঘুমিয়ে আছে সেই ঘরের দিকে গেলাম।। দরজা চাপানো, আমি দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকে দেখি আদিল সত্যিই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।। সময় অসময় আদিলের এই ঘুমিয়ে থাকাটা আমার কাছে বেশ অস্বাভাবিক লাগছে।। কেনো যেনো মনে হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে মানুষ এত ঘুমাতে পারে না।। ফুলবানুকেও দেখতাম রাত দিন ঘুমিয়ে থাকতে।। মাথা কাজ করছে না, আদিলের ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে আমি আবার সবার মাঝখানে চলে এলাম।।
কি নিয়ে যেনো আলাপ হচ্ছিলো, আমাকে দেখে থামিয়ে দিয়েছে।।
আমি সরাসরি ভিতরে ঢুকেই মাসুদকে একটু উঁচু গলায় ডাক দিলাম, মাসুদ কেমন যেনো কেঁপে উঠলো।। আমি বললাম- বাইরে আয় তো, কথা আছে।।
মাসুদ ছোট মামীর দিকে তাকালো, মামী কেমন যেনো চোখ ইশারা দিলেন।। কোন কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ালো না।। মাসুদ উঠে দরজার কাছে আসলো, ওকে সাথে নিয়ে আবার উঠানে গেলাম।।
আমি মাসুদকে একা পেয়ে বললাম- চল, এখনি কবিরাজের বাড়ি যাবো।।
মাসুদ আমার শক্তপোক্ত মুখের পেশী দেখে কেমন যেনো নার্ভাস হয়ে গেছে, সে ম্রিয়মাণ গলায় বললো- ভাই আমি তো বাড়ি চিনি না।।
আমি বললাম- খুব সোজা, আটিয়া গিয়ে কাউরে জিজ্ঞেস করলেই হবে কবিরাজ বাড়ি কোনটা।।
মাসুদ আমার কথায় কোন আগ্রহ দেখালো না, আমি এক প্রকার মাসুদকে জোর করে টেনে নিয়েই রওনা দিলাম।।
পথে যেতে যেতে তারাবানু বেশ কয়েকবার কল দিলো, কত মিথ্যে বলা যায়- তার থেকে ভালো ফোন রিসিভ না করে থাকা।। ফোন মিউট করে দিলাম।।
মাসুদকে বললাম- আচ্ছা, পাগলে কি একা একা ফাঁসি দিতে পারে বল, আর কি জন্যে ফাঁসি দিবে আমারে বুঝা
মাসুদ আমার প্রশ্ন শুনলেই ঢোঁক গিলে বললো- জানি না ভাই, তুমারে একটা কথা কইবার চাই।।
আমি মাসুদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম- কবিরাজ বাড়ি পরে যাবো, আয় ওই জায়গায় একটু বসি।। ভাইডা ভালো কি জানোস আমারে সব বল তো।।
মাসুদকে নিয়ে রাস্তার ধারে ঘাসের উপর বসে পড়লাম, এদিকে গাছপালা আছে বেশ, ছায়ার মধ্যে বসে কেমন যেনো শান্তি লাগছে।।
মাসুদ বলতে শুরু করলো- ভাই শুনো, মামী আমারে কি কয় জানো
– কোন মামী
আরে ছোট মামী, আমারে কয়।। আদিলের বউ যে পোয়াতী হইছে অইডা নাকি আদিলের না।। অইডা বড় মামার কাম।। আর মামী কয় ওই বাচ্চা দুনিয়াতে আইলে খুব অনাচার হইবো, তাই মামী আমারে কইছিলো ফুলিরে খাবারে বিষ দিয়া মাইরা ফেলবো।। তাতে আরো লাভ নাকি আছে, আজ হোক কাইল হোক মামার সব সম্পত্তি নাকি সুইটি আর টুইটি পাইবো আর ওগো জামাই পাইবো।। মানে বুঝোই তো আমারে বুঝায়।। ভাই, আমি শুইনা ডরাই গেছিলাম, মামী আমারে গোপনে গোপনে এইসব কইছে কাল সন্ধ্যায়, তুমি তখন কই জানি ছিলা।। আমারে কইছে, শুভন ঢাকা গেলেই এই কাম করতে, আর আমি যেনো আগেই বাড়িতে না যাই।। তা তুমি তো আইজক্যা এলাসিন গেলা, এই ফাঁকে মামী মনে হয় এই কাম করছে।।
আমি প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো শুনে গেলাম, আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না।। আবার ফেলেও দিতে পারছি না, আচ্ছা মামী যদি বিষ মিশায় সে তো ধরা পড়বেই তাই না।। আবার ফাঁসি কিভাবে দিবে মামী একা একা।। যদি ফুলবানু ঘুমে থাকে তবুও কমপক্ষে দুই তিনজন ছাড়া লাশ উঠিয়ে ফ্যানে ঝুঁলিয়ে দেয়া সম্ভব না।। আমি একবার ভাবলাম, মাসুদকে সিসি ক্যামেরার কথা বলে দেই, যে আমি দেখেছি লাশ নামানো আছে।। কিন্তু আবার ভাবলাম, মাসুদ নিজেও আমার সন্দেহের তালিকায়, তাই কাউকে কিছুই বলা যাবে না।।
আমি বললাম- চল পরে সব শুনবো, আগে কবিরাজ শালারে দুইটা ঢলা দিয়ে আসি।। ওই শালার কাছে অনেক কথা আছে।।
…………
কবিরাজ বাড়িতে নেই, আমাদের পক্ষে অপেক্ষা করাও সম্ভব না।। কবিরাজের ফোন নাম্বার বন্ধ, কবিরাজ কি তবে পালিয়ে গেলো নাকি কবিরাজের বউকে জিজ্ঞেস করলাম, কবিরাজের কথা।। সে বললো, রাইতে বাড়িতে আসবে নাকি বলে গেছে।। আমাদের পক্ষে তো রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না।। আমি কবিরাজের বউকে বললাম- আচ্ছা চাচী, আমরা ওই যে পাথরাইলের মঞ্জু আছে না।। তার ভাগ্নে।। আদিল আমার মামতো ভাই।।
মহিলা বললো- ও আচ্ছা, ওই যে পাগল ছ্যাড়াডা।। চিনছি চিনছি।। তুমাগো বাড়ির বেক্কেরেই আমি চিনি।।
আমি আসলে বুঝতে পারছি না উনাকে কি প্রশ্ন করবো, কোন হিসাব মিলছে না।। এদিকে মাসুদকে কেমন আড়ষ্ট লাগছে, চট করে কিছু একটা আড়াল করলো।। সম্ভবত ওর ফোনে কোন কল আসছে, সেটা মাসুদ দেখাতে চাচ্ছে না।। আমি অনুমান করে নিলাম ছোট মামীর কল হতে পারে।।
মহিলা আমাদের উল্টা প্রশ্ন করা শুরু করলেন- কি দরকারে এসেছি, আমাদের কোন শারীরিক সমস্যা আছে কিনা
আমি জবাব দিলাম- না।। অন্য এক কাজে আসছিলাম আর কি।।
হঠাৎ মহিলা বলে উঠলো- আমাগো কবিরাজের কাছে বেক্কেই আহে, তুমার বড় মামা মামী তো পুলা আর পুলার বউ নিয়া আহেই আবার কয়দিন দেখলাম তোমার ছোট মামীও আইলো।।
আমি চমকে গেলাম, ছোট মামী আসে মানে।। এটা তো জানা ছিলো না, মাসুদের দিকে তাকালাম।। মাসুদ নিজেও অবাক।।
আমি মহিলার সাথে কৌশলে আরো কিছু আলাপ করলাম, আমি বললাম- আচ্ছা আদিলের বউ যে পোয়াতী হইলো, অইটা কি কবিরাজের ঔষুধে হইছে
মহিলা বললো- কবিরাজ তো ওসিলা মাত্র, সব আল্লাহ্ তালায় করছে।। তয় আমাগো কবিরাজ খুব গরম কবিরাজ, হ্যার ঔষুধ মিস যায় না।। আর শুনো বাবা, ওরা জামাই বউ তো খালি কাইজ্জা করতো, মারামারি করতো, তহন আমাগো কবিরাজ বড়ি দিলো, হেই বড়ি রাইতে খাওনের লগে মিশিয়ে দিলেই হারাডা দিন ওরা ঘুমায়।। নইলে সর্বনাশ হইয়া যাইতো, এক পাগল সামলান যায় না, আবার দুই পাগল।।
আমি যেনো আস্তে আস্তে আলোর মুখ দেখছি।। মনে হচ্ছে যেহেতু আদিলের বউ ঘুমে থাকে আদিলের বউয়ের সাথে বড় মামা যদি বাজে কিছু করেও থাকে এটা সম্ভব।। আচ্ছা দুইটা হিসাব হতে পারে- মামা এমন কিছু করেছে এটা জেনে বড় মামী ফুলবানুকে মেরে ফেলেছে।। আবার ছোট মামীর এখানে আসার কারণ কি মামী তো রীতিমত ফুলবানুকে খুন করার প্লানও করে ফেলেছিলো।।
আমি মহিলার সাথে আলাপের পাট চুকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরলাম।। পথে ফোন বের করে দেখলাম, স্টার অনেকগুলো কল দিয়েছে।। ফোন সাইলেন্ট করাই ছিলো। আমি তারাবানুকে কল ব্যাক করে শুধু বললাম- আব্বু সুস্থ আছে, আমি আজ আর যাচ্ছি না।। তবে খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আবার দেখা হবে।।
তারাবানুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।।
আমি আর মাসুদ বেশ দ্রুত হেঁটে বাড়িতে এসে পৌঁছালাম।। এরমধ্যে মাসুদ একবার মামীর কল রিসিভ করে বলেছে- মামী আমরা একটু বাজারে গেছিলাম, চা খাইতে।। শোভন ভাইয়ের নাকি চিন্তায় মাথা ব্যথা করছিলো, তাই একটু কড়া চা খাইলাম।।
বাড়িতে গিয়ে, দেখি সব কিছু আগের মত স্বাভাবিক আছে।। আমি মাসুদকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।। গিয়ে চমকে গেলাম, এই ঘরে নতুন এক সদস্য যুক্ত হয়েছে।। উনাকে চিনি না।। তবে একটু পরেই বুঝলাম, কবিরাজ মশাই এখানে।।
আমার মাথা আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে, ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।। মাসুদ নিজেও বেশ অবাক হলো।। আমি ঘরে খানিক বসে রইলাম, কেউ তেমন কোন কথা বলছে না।। শুধু কবিরাজ বলছে- সব আল্লাহর ইচ্ছা, কে কইছে পাগলে ফাঁস নিতে জানে না।। পাগলে কত কি করে তার ঠিক আছে।।
পুলিশ মুলিশ ডাইকা কাম নাই, ওই বাড়ির লোকগো ডাকেন আমি বুঝাইয়া কই।। ওরা কাউরে না কইলেই হইবো, ওগো মাইয়া ফাঁস নিছে।। কইবো পোয়াতী আছিলো মইরা গেছে।।
আমি কবিরাজের কথা নিতে পারছি না, ওর চেহারার মধ্যেই দুনিয়ার শয়তানী লুকানো আছে।। মনে হচ্ছে এই বদমাইশটার বুক বরাবর একটা লাত্থি দিতে পারলে, শান্তি পেতাম।।
আমি আবার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, এখনো ওই রুমে তালা দেয়া।। ভাবছি আদিলকে একবার দেখে আসি।। উঠানে এসেই মনে হলো, দেখি তো রুমে ভিতর ফুলবানুর লাশের কি অবস্থা।। ক্যামেরা কানেক্ট করে ভূত দেখার মত চমকে গেলাম।। এটা কি হলো, এটা কিভাবে হলো!! ফুলবানুর লাশ ফ্যানের সাথে ওড়নাতে ঝুলছে।। আমি আর এই দৃশ্য হজম করতে পারছিলাম না, আমার বুক ব্যথা করছে, পুরো শরীর মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাচ্ছে।। যে কোন সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো যাবো ভাব।। নিজেকে সামলে নিলাম কোনরকম, কি এক অদ্ভুত যুদ্ধ আমার, এই যুদ্ধে কে যে মিত্র আর কে যে শত্রু তাই বুঝতে বুঝতেই জীবন শেষ।।
আচ্ছা, তারমানে কি বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে ফুলবানুকে এখন লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হলো আচ্ছা কবিরাজ কোন রাস্তা দিয়ে বাড়িতে এলো কবিরাজ তো নাকি সকালে বের হয়ে গেছিলো নিজের বাড়ি থেকে।।
কেনো কেনো
অসহ্য!!।।
……
চলবে-
…………
পরের পর্বে সমাপ্ত।।
……………
…………
© রাজভী রায়হান শোভন ( Razvi Rayhun Shovon )