দুটা সিটে দুজন মহিলা এসে বসলেন

দুটা সিটে দুজন মহিলা এসে বসলেন
২০১৫ সাল এইচ. এস. সি পরিক্ষার পর ঢাকায় একটা কোচিং এ ভর্তি হয়েছি। সিলেট থেকে জৈন্তিকা এক্সপ্রেসে ঢাকা যাচ্ছিলাম। ৮:৪০ সিলেট থেকে ট্রেনটা ছেড়ে গেল। জীবনে প্রথম বার বাড়ি থেকে এতটা দূরে যাচ্ছি…..
মনটা এমনিতেই খারাপ।
চুপচাপ সিটে বসে আছি আর আর মাঝে মাঝে চারপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছি। এই যান্ত্রিক জীবনে কত ব্যস্ততা কারো দিকে তাকানোর কারো এক মুহূর্ত সময় নেই। ট্রেন চলছে…..।
পরের স্টেশনে যখন ট্রেনটা থামতেই অনেকগুলো নতুন মুখ দেখতে পেলাম।
আমার ডানপাশের দুটা সিটে দুজন মহিলা এসে বসলেন। সাথে তিনটা বাচ্চা, আরেকজন পুরুষ। কথাবার্তা শুনে মনে হল লোকটা মহিলাদ্বয়ের শশুর হবেন, বেশ বৃদ্ধ। বড় বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে আমার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়ত উনি দুইটা সিটই পেয়েছেন।
বিষয়টা কেমন অস্বস্তিকর, সিটের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাক তাতে আমার কি আমার সিটে আমি বসে আছি। নিজের সিট ছেড়ে অন্যজনকে সিট দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। আমার টাকা দিয়ে কেনা সিট অন্য কাউকে দেওয়ার প্রশ্নইই আসে না।
আমি ঠায় কানে হেডফোন দিয়ে সিটে বসে আছি। ট্রেন চলছে….।
আরো কয়েকটা স্টেশন ছেড়ে যাবার পর লক্ষ্য করলাম লোকটার দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। সাথের বাচ্চাটা বার বার বলছে দাদু পায়ে ব্যাথা করছে…।
দেখলাম আশে পাশে বসে থাকা কয়েকজনও বিষয়টা লক্ষ করছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই হয়ত আমার মতই ভাবছে।
বিষয়টা কেমন যেন খারাপ লাগছে। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম দাদু আপনি এখানে বসুন। ভদ্রলোক হাসিমুখে বলল না না এটা তো তোমার সিট তুমি বস। আমি কিছু না বলে সিটটা ছেড়ে উঠে গেলাম।
ভদ্রলোক হাসিমুখে নাতনিকে নিয়ে বসলেন।
ট্রেন চলছে… বেশ কয়েকটা স্টেশন ছেড়ে গেল। ভদ্রলোক বসে আছেন। মনে মনে ভাবছি ভদ্রলোক কোথায় নামবেন তাও তো জানি না। কিছু বলতেও লজ্জা লাগছে। সিটটা দিয়ে বোকামি করলাম না তো। ট্রেনটা চলছে….।
পড়ন্ত দুপুর…. ঠায় ২-৩ ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনটা তখন ভৈরব স্টেশনে ঢুকছে…। হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে ডাকলেন। হাসিমুখে বললেন আমরা এখানে নেমে যাব তুমি বস। আমার নামট ও জিজ্ঞেস করলেন?
পাশে বসা ভদ্রমহিলারাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
নেমে যাওয়ার সময় ভদ্রলোক আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন ভাল থাক বাবা। কিছুই বললাম না শুধু উনার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মানুষের চোখ তার মনের না বলা কথা গুলো ও বলে দেয়। উনার চোখে যে কৃতজ্ঞতা যে ভালবাসা দেখেছিলাম হয়ত দুনিয়ার কোন কিছুর বিনিময়ে পাওয়া সম্ভব না।
জীবনে প্রথমবার কেমন যেন একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। হয়ত কিছু শব্দে সেটা লেখা সম্ভব না।
ভদ্রলোক যেদিকে চলে গেলেন সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। হটাৎ লক্ষ করলাম চোখটা যাপসা হয়ে আসছে।
হয়ত নিঃশর্তভাবে কারো জন্য কোন কিছু করার আনন্দটাই এমন।
সিটে বসতেই পাশের জন বলল ভাই আপনি বোকা নাকি নিজের সিট কেউ অন্যকে দেয়? কিছুই বললাম না, নাহয় কিছু মানুষের কাছে বোকা হয়েই থাকলাম।
(জীবন থেকে নেয়া একটি গল্প)
লেখক – নয়ন