ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-৫)

ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-৫)
বাবার বিয়ে
বাংলাদেশের পরের কয়কটা দিন দিদার কাছেই ছিলাম। দিদা এবার আর আমাদের সাথে ফিরছে না। দিদাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে? সেটা ভেবে আমারও মন খারাপ আর দিদারও। পই পই করে প্রতিদিন বলছে ‘নতুন মায়ের কথা শুনবে সব সময়। ওকে একদম জ্বালাবে না। আমি তো ওখানে থাকবো না। ‘ দিদার কথা শুনে মাঝে মাঝে লিজের স্টেপ মমের কথা মনে হয়, বাথরুমে আটকে রাখার ভয়টা ফেরত আসে।
‘দিদা ওকে বলে দাও আমাকে যেন বাথরুমে আটকে না রাখে।’
আমার কথা শুনে দিদা আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
এই কাঁদে, এই আবার বলে ‘দাদু, তোমার খাওয়া দাওয়ার যে কী হবে? বাবা, মা যা খায়, তাই খেও। খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করো না। মা তো কিছুই রান্না করতে পারে না।’
আবার কাঁদে।
আমাদের কান্না কাটি দেখে মা হাসি চাপে। ‘মা এতো কান্না কাটি না করে আপনি বরং ওই নুডলস, ফ্রায়েড রাইস, সুপ এসব রান্নার রেসিপি গুলো একটু ভালো করে লিখে দিন আমাকে। আর দেশের পাট পুরোপুরি চুকিয়ে আমাদের ওখানে চলুন। ‘
আমিও দিদাকে চেপে ধরি ‘চলো না দিদা।’
‘আসবো দাদু, এখানে অনেক কাজ বাকি। আর আমার অন্য ছেলে মেয়েরা সবাই এখানে না? ওরাও তো আমাকে চায়। ‘
মন খারাপ আর চিন্তার মাঝে আমরা ফিরে এলাম, আমি, মা আর বাবা।
এয়ারপোর্টে নানাভাইটা আর মা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে অনেক কাঁদল আর আমি আর দিদা তার চেয়েও বেশি কাঁদলাম। শুধু বাবা কাকে রেখে কাকে থামাবে বুঝতে পারছিল না।
বাড়িতে এসে আমি দৌড়ে গেলাম আমার আর দিদার ঘরে। দিদা নেই, আমার একটু ও ভালো লাগছে না। আমাকে কি একা ঘুমাতে হবে? আরে এই চিন্তাটা তো মাথায় আসে নি। মন খারাপের সাথে এখন ভয়ও লাগছে। কখন যেন মা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় ওর স্পর্শ পেতেই আমি কেঁদে ফেললাম।
‘দিদার জন্য মন খারাপ লাগছে?’
আমি কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ।’
‘তোমার এখন কিছুদিন এ ঘরে আসার দরকার নেই। তুমি আমাদের সাথে ঘুমাবে কদিন।’
আমি খুব অবাক হলাম ‘মা কিভাবে আমার মনের কথা জানতে পারলো?
আমরা আবার ফিরে এলাম আমাদের স্বাভাবিক জীবনে। তবে আগের মত নয়। সংসারের পুরো দায়িত্ব এখন মা আর বাবার কাঁধে। মা রান্না করতে পারে না। চেষ্টা করে তবুও। বাবাও সাহায্য করে। বাবাই বরং মায়ের চেয়ে মনে হয় একটু ভালো পারে। অন্তত মা তাই বলে। খাওয়া নিয়ে আমার সব সময়ই সমস্যা। আমার বেশির ভাগ খাওয়া খেতেই ভালো লাগে না। দিদা নাকি অনেক ভালো রান্না করে, বাবা, মা সবাই তাই বলে। কিন্তু দিদার সব কিছু ও আমি খেতাম না। আমি কী করব? আমার খিদে লাগে না। খেতে আমার ভালো ও লাগে না। ভাগ্য ভাল মা দিদার মত জোরাজুরি করে না। দিদার এই একটা ব্যাপারে ধৈর্যের কোন শেষ ছিল না। সারাদিন আমার পেছনে খাওয়া নিয়ে লেগে থাকতো। আর খালি ভাত খেতে বলত, অথচ ভাত আমার একদম ভালো লাগে না।
মা অনেক বুদ্ধিমান। ও জেনে নিয়েছে ঠিক কী কী খাবার আমি খেতে পছন্দ করি। তার ভেতরেই রুটিন করে ফেলেছে। দিদার কাছ থেকে রেসিপি এনেছে। তার পরেও ওকে ফোনে মাঝে মাঝে পরীক্ষা দিতে হয় দিদার কাছে।
আমরা এখন মাঝে মাঝে দোকানের খাওয়াও খাই। অন্য স্টাইলের খাওয়া। কিছু কিছু আমার মজাই লাগে। বাসায় আমার নিজেকে একা একা খেতে হয়। কিন্তু বাসায় মেহমান আসলে বা দাওয়াতে গেলে আমি ফাঁকি দিতে চেষ্টা করি। আর মা তখনই আমাকে চেপে ধরে। একটু কিছু খেতেই হয়, ওর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ও যে আমাকে পিছে পিছে থেকে খাইয়ে দেয়, আনটিরা সব অবাক চোখে দেখে। আমার খুব বিরক্ত লাগে। ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? সব মাই তো ওদের বাচ্চাদেরকে খাইয়ে দেয়।’
আমাদের দিন ভালোই চলছিল, শুধু দিদার জন্য মাঝে মাঝে একটু খারাপ লাগে। আর দিদা আমাকে স্কাইপে দেখে নিয়ম করে কাঁদবে আর বলবে ‘আমার দাদু ভাইটা একদম শুকিয়ে গেছে। ওর নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে?’
মা হাসে আর বলে ‘তা তো একটু হচ্ছে। কি করা? ওর মা তো ভালো রান্না করতে পারে না।’
এই কথা শুনে দিদা আরও রেগে যায়।
দিদা আবারও জিজ্ঞেস করে ‘তুমি এখন কার সঙ্গে ঘুমাও? ‘
‘মা আর বাবার সঙ্গে।’
মনে হয় ওর মনটা একটু খুশি হয়।
কিছু দিন হল মায়ের কী যেন হয়েছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে কেন যেন আর বেশি কাছে টানে না। পড়াতে বসলে ঝিমাতে থাকে। একটু পরে বলে ‘আজ আর থাক। কেমন?’
রাতে গল্প শুনাতে গেলে একটু পরেই ঘুমিয়ে যায়।
একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় চুল বাঁধার জন্য ওকে খুঁজছি। কোথাও না পেয়ে যেয়ে দেখি ও বাথরুমে দাড়িয়ে বমি করছে। এদিকে আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যেয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম ‘মা, আমাকে দুটো বেণি করে দাও।’
ও কথা না শুনে খালি ‘ওয়াক ওয়াক করছে।’
আমি দুই বার বলার পর ও আমাকে রাগ হয়ে বলল ‘দেখছ না, আমি বমি করছি?’
‘কিন্তু আমাকে কে চুল বেঁধে দেবে? ‘
ও উত্তর না দিয়ে আমাকে হাতের ইশারায় ওখান থেকে চলে যেতে বলল, আমি যাচ্ছি না দেখে আমাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। সেদিন স্কুলে যেতে যেতে আমি কেঁদেছি।
আমাকে তো মা সেদিন লাঞ্চও দেয় নি। খালি পেটে সারাদিন আমার খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু ঠিক করলাম কেউকে কিছু বলব না। বাবাকেও না।
এর পর থেকে এরকম ঘটনা আরও হতে শুরু করল। দুপুরে স্কুল থেকে এসে মাঝে মাঝেই মা ঘুমিয়ে পড়ত। বাবা আজকাল বেশি রান্না করে বা দোকান থেকে খাওয়া কিনে আনে।
আমার খুব কষ্ট হয়। মাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। ও কেন আর আমার সাথে খেলে না? গল্প পড়ে শোনায় না? খেলায় ও আজকাল বাবাই বেশি নিয়ে যায়।
সেদিন স্কুল থেকে এসে আমার কিছুই করার ছিল না। মা ঘুমুচ্ছে। আমি অনেক কিছু চেষ্টা করে কিছুতেই মন বসল না। তারপরে যেয়ে মায়ের পাশে বিছানায় লাফাতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ওর ঘুম ভাঙ্গানো। তারপরে বলব পার্কে নিয়ে যেতে। আজ ওকে নিতেই হবে। কতদিন আমাকে পার্কে নিয়ে যায় না। আমি নাহলে দিদাকে বলে দেব।
লাফাতে গিয়ে কখন যেন ওর গায়ের উপরে পড়ে গিয়েছি। মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটু রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে ছিল।
‘বিছানায় লাফাচ্ছ কেন হৃদি?’
‘আমাকে পার্কে নিয়ে চল। ‘
‘আমি তো ঘুমাচ্ছি। আজ তো পার্কে যাওয়া হবে না।’
‘কেন হবে না? তুমি আমাকে আর পার্কে নিয়ে যাও না, আমার সাথে খেল না। তুমি আমাকে আর একটুও আদর কর না কেন?’
বলেই আমি কাঁদতে শুরু করলাম।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘আমার তো শরীর ভালো না। ডাক্তার আমাকে এখন অনেক রেস্ট করতে বলেছে। ‘
আমি আরও জোরে কাঁদতে শুরু করলাম ‘কই তুমি তো বাবার সাথে কাল রাতে হেসে হেসে কথা বলেছ? বাবা তোমাকে দুধ খেতে বলল, তোমার গ্লাস থেকে বাবাকেও খাইয়ে দিয়েছ।’
ও কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলাল। তারপর আমাকে বলল ‘ তোমার একটা ছোট্ট ভাইয়া আসছে, ও এখন আমার এই পেটের মধ্যে লুকিয়ে আছে।’ বলেই ও আমার হাতটা ওর পেটের উপরে টেনে নিল।
আমি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকলাম।
‘বেবিটা খুব দুষ্টামি করে বলে ডাক্তার আমাকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলেছে। ‘
আমি ওর বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে বললাম ‘মা তুমি কাকে বেশি ভালবাসবে? আমাকে নাকি ওই ভাইয়াটাকে?’
চলবে……!!!!
সাথেই থাকুন…….!!!!!