Bangla ArticlesBangla StoryStory (Writer)

ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-৩)

ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-৩)

বাবার বিয়ে

আজও ঘুম ভাঙল সাবিনার ডাকে। বাবা, সাবিনা সবাই দেখি বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি। তাইতো, আজ তো বাবার অফিস আছে। আমারও স্কুল আছে। বাবা আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যায়। স্কুল শেষে আমি থাকি স্কুলেরই একটা ডে কেয়ারে। ওখানে আমার একদম ভালো লাগে না। বিকালে বাবাই আবার নিয়ে আসে। সাবিনা আমাকে ডেকে দিয়ে চলে গেছে। মনে হয় কিচেনে। বিছানার উপরে জামা রাখা, জুতো পাশে। বাবা চুল আঁচড়াচ্ছিল। দিদা আমাকে মুখ ধুইয়ে এসে বাবাকে বলল ‘বউমা আবার কোথায় যাচ্ছে?’
‘হৃদির স্কুলে, স্কুলের শেষে ওকে যেয়ে নিয়ে আসবে। আজ থেকে হৃদি আর ডে কেয়ারে থাকবে না।’
দিদার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
‘তুই তো তখন থাকবি না। একা বাসায়। তোর সামনে একরকম।’
আমি খুব খুশি। ‘সত্যি বাবা, আমাকে আর ডে কেয়ারে থাকতে হবে না?’
বাবা গম্ভীর হয়ে বলল ‘কিন্তু বাসায় এসে মাকে জ্বালানো যাবে না। ওর কথা শুনতে হবে। ও কিন্তু খুব কড়া। ‘
গাড়িতে সাবিনা আমাকে বলল ‘আমি তোমাকে স্কুল শেষে নিয়ে যাব। টিফিন গুলো খেও, আমি নিজে বানিয়েছি। হোম ওয়ার্ক বুঝে আসবে টিচারের কাছ থেকে। মনে আছে তো আমি তোমাকে সব পড়া শিখিয়ে দেব? আর কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি তোমার মা।’
শেষের কথাটা ও আমাকে কানে কানে বলল, আমি বুঝলাম এটা আমাদের দুজনের সিক্রেট। বলেই ও হাসল আর আমিও।
গাড়ি থেকে নামার সময় ও আমাকে একটা চুমু দিল। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল, কে জানে হয়তো আমাদের ক্লাসের কেউ দেখে ফেলেছে।
ক্লাস শুরুর আগের টাইমটা আমার খুব খারাপ কাটে। সবাই খেলে, আমাকে কেউ নেয় না। কয়েকদিন আমি একাই ওদের পেছন পেছন দৌড়ে ধরতে চেষ্টা করেছি, আমাকে কেউ ধরে না। এখন আমি একা একাই হেঁটেবেড়াই। মাঝে মাঝে একা একা মায়ের সঙ্গে কথা বলি নিজের মনে।
আজ একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমাকে দেখে লিজ ছুটে এল। ‘তোমার জামাটা খুব সুন্দর তো, আর এতো সুন্দর করে কে চুল বেঁধে দিল? ‘
আমি বেশ গর্বের সাথে বললাম ‘আমার মা।’
‘স্টেপ মম?’ লিজ বেশ বিজ্ঞের মত বলল।
আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
‘তুমি কি লাকি। আমার স্টেপ মম সারাদিন বাবার সাথে ঝগড়া করে। আমাকে একদিন বাথরুমে আটকে রেখেছিল।’
এই কথা শুনে আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকালাম। কিন্তু লিজ খুব নিরীহ টাইপ, ওর মিথ্যা কথা বলার কথা না।
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। সারাদিন আমার এই চিন্তায় গেল, স্কুল থেকে নিয়ে ও যদি আমাকে বাথরুমে আটকে রাখে। একবার ভাবলাম দিদা আছে। আবার মনে হল দিদাকেও আটকে রেখেছে হয়ত বা। আজ ক্লাসে অনেকেই আমার পাশে বসছে, কথা বলছে।
সাবিনা বলে দিয়েছে হোম ওয়ার্ক বুঝে নিতে। কিন্তু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আবার ভয় লাগছে, যদি শাস্তি দেয়।
লাঞ্চে দেখি স্যান্ডউইচ দিয়েছে। আমি স্যান্ডউইচ একদম পছন্দ করি না। শুধু আঙ্গুরগুলো খেলাম। খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে কনুই ছিলে গেল। চোখে পানি চলে এসছে, কিন্তু আমি কেউকে কিছু বললাম না। সাবিনা যদি রাগ হয়।
স্কুল ছুটির পর দেখি ও স্কুলের গেটে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল।
‘ব্যাথা পেলে কেমন করে?’
‘খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি। তুমি রাগ করবে না তো? ‘
ও খুব অবাক হয়ে গেল ‘না, রাগ করব কেন?’
আমার বন্ধুরা আর ওদের মা বাবারা অনেকেই আমাদের খেয়াল করছিল।
বাসায় এসে টিফিন বক্স খুলে ও খুব মন খারাপ করল। ‘একটুও খাও নি? ভালো হয় নি?’
‘আমি স্যান্ডউইচ খাই না। দিদা আমাকে ফ্রায়েড রাইস, নুডলস করে দেয়। তুমি ওগুলো পারো না?’
‘না, আমি রান্না পারি না। ‘ বলে ও লজ্জা পেলো।
‘কিছু হবে না, দিদা রান্না করবে। তাই না দিদা?’ আমাদের কথা দিদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল
‘ নুডলস রান্না আবার একটা রান্না নাকি? তুমি সেটাও পারো না? হাসিব কিন্তু খুব খেতে পছন্দ করে।’
‘কিছু করার নেই মা, আমার রান্না করতে ভালো লাগে না।’
দিদার চেহারাটা কেমন জানি হয়ে গেল।
দুপুরে গোসল, খাওয়ার পরে ও আমাকে ঘুম পাড়াতে অনেক চেষ্টা করল। আমি টিভি দেখবই। দিদা আমাদের পাশে পাশেই থাকছে সব সময়। আমার সাহস বেড়ে গেল, ও আর আমাকে বাথরুমে আটকাতে পারবে না।
‘টিভি দেখলে দেখুক না।’ দিদার কথায় আমি আরও সাহস পেলাম।
‘মা আপনি দেখেছেন ও সারাক্ষণ কেমন চোখ পিটপিট করে? ওর চোখের সমস্যা হয়েছে। ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে।’
দিদা দুপুরে ঘুমায়। তাই আর বেশি হই চই চাচ্ছিল না। কিন্তু সাবিনার এক কথা ‘না ঘুমালে অসুবিধা নাই, কিন্তু টিভি দেখা, গেম খেলা যাবে না।’ আমাকে লোভ দেখাল এখন ওর কথা শুনলে বিকালে পার্কে নিয়ে যাবে।
একসময় ক্লান্ত হয়ে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর এই সুযোগে আমি চলে গেলাম গেমের রাজ্যে।
গেম খেলার জন্য আমি সত্যি সত্যি শাস্তি পেলাম, পার্কে যাওয়া হল না। অনেক চিৎকার করেও লাভ হল না। আমার চিৎকার শুনে দিদা অনেকক্ষণ গজ গজ করল। সাবিনা আর কিছুই বলছে না।
বাবা আজ আগেই এসে গেছে। অন্য সময় যদি আমি কখনো বাসায় থাকি, বাইরে থেকে এসেই বাবা আমাকে ডাকে ‘হৃদি, হৃদি।’
আজও আমায় ডাকল। কিন্তু আমি যাওয়ার পর ও আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল ‘মা কই?’
আমার খুব রাগ লাগছিল। রেগে রেগেই বললাম ‘জানি না।’
বাবা আমাকে কোলে তুলে নিল। আর কোলে নিয়েই ওর চোখে পড়েছে আমার হাতের ছিলে যাওয়া জায়গাটা।
ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘মা মেরেছে?’
আমি মিথ্যা করেই বললাম ‘হ্যাঁ। ‘ ও কেন আমাকে পার্কে নিয়ে গেল না? এখন বেশ হবে।
বাবা অনেক রেগে গিয়েছে। আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে রুমে গেল। সাবিনাও রুমে ছিল। রুমের বাইরে থেকেই আমি শুনলাম সাবিনা হেঁসে হেঁসে বলছে ‘ওহ এসে গেছো? আমি তো ভেবেছি আরও দেরি হবে। একটু সাজ গোঁজ করার চান্স দিলে না? চা খাবে? ‘
বাবা বেশ রেগে রেগে বলল ‘হৃদিকে মেরেছ কেন? ও কী করেছে?’
সাবিনা খুব অবাক হয়ে বলল ‘কী বলছ এইসব? আমি ওকে মারতে পারি?’
‘ও তাহলে ব্যাথা পেল কিভাবে?’
সাবিনা কেমন করে যেন বলল ‘ওকেই জিজ্ঞেস কর না। আমাকে যখন সন্দেহই করছ। ‘
বাবা এবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল ‘কিভাবে ব্যাথা পেয়েছ? ‘
আমি ভয় পেয়ে সত্যি কথা বলে দিলাম ‘স্কুলে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।’ বলেই আমি সেখান থেকে দৌড়।
কিছুক্ষণ পড়ে দেখি দিদা বাবাকে চা খেতে ডাকছে। টেবিলে চা দিতে দিতে বলল ‘তোর বউ নাকি নুডলস বানাতে জানে না। কে জানে, চা বানাতে পারে নাকি।’
‘তুমি শিখিয়ে দিও ওকে।’
‘তাই তো আশা করেছিলাম, কিন্তু মুখের উপরে বলে দিল রান্না বান্না ওর কাজ না। আজকালের শিক্ষিত মেয়েদের ভাব সাব আলাদা।’
বাবা মনে হল আবার রাগ হয়েছে।
আমি আবার একা একা এদিক ওদিক ঘুরছি। কতক্ষণ গেম খেললাম। কিছুই ভাল লাগছে না। হটাত মনে হল, সাবিনাকে যেয়ে বলি গল্প পড়ে শুনাতে। ওর রুমে ঢুকে দেখি ঘর অন্ধকার করে বসে আছে জানালার পাশে। আমি রুমে ঢুকেছি ও টের পায় নাই। পেছন ফিরে আছে। কিন্তু আমি বুঝে গেছি ও কাঁদছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি মিথ্যা বলেছি তাই বাবা ওকে বকা দিয়েছে। এখন আমি কী করি?
কিছু না ভেবেই ওকে পেছন থেকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম ‘মা, তুমি না বলেছিলে আমাকে হোম ওয়ার্ক দেখাবে?’
সাবিনা কেঁপে উঠল। আমাকে জড়িয়ে ধরল।
‘মা, আমি সরি। বাবাকে আমি মিথ্যে করে বলেছি, তুমি আমাকে মেরেছ। আমাকে যে পার্কে নিয়ে যাও নি সেজন্য আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি আর কখনো মিথ্যে বলব না মা। তুমি কেঁদো না। ‘
ও আমাকে পাগলের মত কপালে গালে চুমু খাচ্ছিল আর বলছিল ‘আমি তো তোমার মা, তুমি আমার লক্ষ্মী মেয়ে।’
সেদিন থেকে শুরু হল আমাদের মা আর মেয়ের যৌথ লড়াই। মা কত যে রাজ্যের বই নিয়ে আসল। আমি আসলে পড়া লেখায় অনেক পিছিয়ে ছিলাম। আমার ক্লাসের সবাই যখন বানান করে, যোগ, বিয়োগ করে আমি তখনও অক্ষর আর নাম্বার নিয়ে হিমশিম খাই। ও খুব চেষ্টা করছিল, কিন্তু বাবাকে বার বার বলত, আমার তো ছোট বাচ্চার অভিজ্ঞতা নেই। আর আমার কেন যেন কিছুতেই মন বসত না। এটা আমার সব সময় হয়, একটা চিন্তার মধ্যে আরেকটা চলে আসে। একটু বসলেই অস্থির লাগে। পড়ালেখায় খুব বেশি আগাতে পারছি না। মা বাবাকে ঠেলছিল টিচারের সাথে দেখা করতে। বাবা সময় পায় না। এই বছর আমাদের বার্ষিক ওপেন হাউসেই তো বাবা যায় নি। সবার বাবা, মা এসেছিল আর বাচ্চাদের কাজ দেখে কত খুশি, প্রশংসা। আমি ও তো একটা খুব সুন্দর ছবি এঁকেছিলাম, আমার আর বাবার। বাবা আসলে নিশ্চয়ই অনেক খুশি হত। আমি সেদিন একটু কেঁদেছিলাম।
এর মধ্যে আরেক কাণ্ড হল। রাশার সাথে আমার একটা মারামারি হয়ে গেল, ওকে আমি বেশি জোরে ধাক্কা দেই নাই যদি ও, কিন্তু ওর ঠোঁট কেটে গিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে ও বলেছিল ‘ এজন্যই তোমার সাথে কেউ খেলে না।’ আমার আরও রাগ উঠে গিয়েছিল।
বাসায় চিঠি আসল প্রিন্সিপালের। গার্জিয়ানের সাথে দেখা করতে চায়। সেদিন রাতে আমি আবার একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখলাম। আমাকে একটা ডাইনোসার খেতে আসছে। ভয়ে চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমার চিৎকারে মাও জেগে গেছে, বাবাও। ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম দেখে মাও ভয় পেয়েছে মনে হল, বাবা ওকে সান্ত্বনা দিল ‘ওর মাঝে মাঝে এমন হয়।’ বাকি রাতটা আমি মার গলা জড়িয়ে ধরে থাকলাম শক্ত করে।
পরের দিন বাবা যেতে পারে নি স্কুলে, ওর মিটিং ছিল। জানি না মায়ের সাথে প্রিন্সিপালের কী কথা হয়েছিল, কিন্তু ও খুব চিন্তিত ছিল। তেমন একটা মজা হল না আর বাকিটা দিন।
রাতের বেলা মা বাবা আর দিদাকে বলছিল ‘হৃদির প্রিন্সিপাল আর টিচার বলেছে ওকে একজন মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে। ওর রাগ খুব বেশি। প্রায়ই মারামারিতে জড়িয়ে যায়। পড়ায় মনোযোগ তো দিতেই পারে না, অন্য বাচ্চাদেরও বিরক্ত করে। ‘
বাবা আর দিদা দুজনেই একথা শুনে বিরক্ত। রাগ সামলাতে না পেরে দিদা বলে বসল ‘মানসিক রোগের ডাক্তার? আমার নাতনি কি পাগল নাকি? ‘
আমি একটু দুরেই বসে খেলছিলাম কার্পেটের উপরে। ওরা নিজেদের কথায় এতো মগ্ন ছিল খেয়াল করে নি।’
মা উত্তর দিল ‘মা আমিও দেখেছি, ওর এই সমস্যা গুলো আসলেই আছে, এই কয়দিন আমি ভালো করে খেয়াল করেছি। কাল রাতেও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ওর মায়ের সমস্যার প্রভাব ওর উপরে থাকতেই পারে।’
এইবার বাবা মুখ খুলল ‘বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে ওরকম একটু আধটু ভয় পায়ই। এটা কোন বড় সমস্যা না। ‘
বাবার কথায় সাহস পেয়ে দিদা বেশ কেটে কেটে বলল ‘নাকি ওকে পাগল প্রমাণ করতে পারলে তোমার ও সুবিধা হয়? পথের কাঁটা আর থাকল না?’
মায়ের চেহারাটা যে কেমন হল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভীষণ ভয় পেলাম। আচ্ছা ‘পথের কাঁটা মানে কী?’

চলবে ………………………..

Mohona Islam

Love, Sci-fi, Tech, Story Writer.

Related Articles

Back to top button
error: Alert: Content is protected !!