ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-২)

ছেলে বেলার ডায়েরী (পর্ব-২)
বাবার বিয়ে
সকালে ঘুম ভাঙল সাবিনার ডাকে। পেছনে বাবাও আছে। সাধারণত দিদা আমাকে ডাকে। আজ ওকে কোথাও দেখলাম না। আমি চুপ করে শুয়ে থাকলাম। দিদাকে ছাড়া আমি উঠবো না বিছানা থেকে। বাবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে। সাবিনা কি বাবাকে বকা দিয়েছে নাকি? এসব যখন ভাবছি, সাবিনা এসে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল ‘গুড মর্নিং প্রিন্সেস। নাস্তা খাবে না? ‘
আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম ‘না, আমার খিদে পায় নি।’
‘ঠিক আছে। খিদে তো নাই পেতে পারে। কিন্তু বাবাকে দিয়ে যে আমি প্যান কেক আনালাম, সব গুলো প্যান কেক কি আমি একাই খেয়ে ফেলব?’
প্যান কেকের কথা শুনে আমি উঠে বসলাম, আমার খুব প্রিয়। সাবিনা যদি সত্যি সত্যি সব খেয়ে ফেলে। কিন্তু আমি তো এখনো দাঁত ব্রাশ করি নি।
ওই আমাকে বলল ‘চল মুখটা ধুয়ে দেই।’
আমি ঘাড় গুজে থাকলাম। ‘তুমি না, দিদা বা বাবা।’
একটু পরে ও দিদাকে ডেকে দিল আর আমাকে বলল ‘দিদা মুখ ধুয়ে দিচ্ছে, কিন্তু চুলটা আমি বেঁধে দেব, আমি অনেক ভাবে চুল বাধতে জানি।’
দিদা যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ও কেন যেন বাবাকে আস্তে করে বলছিল ‘জলদি দোকানে যাও প্লিজ, মুখ ধুয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে নাস্তা রেডি রাখতে হবে।’
মুখ ধুয়ে এসে দেখি ও একটা জামা হাতে নিয়ে বসে আছে, খুব সুন্দর জামা।
‘কাল তোমাকে বলেছিলাম আমার কাছে আসলে সুন্দর জামা দেব, এই নাও এটা পরে নাও। আজ বাসায় মানুষ জন আসতে পারে। তোমাকে সুন্দর লাগবে।’
তারপরে চিরুনি দিয়ে আমার চুল আঁচড়াতে শুরু করল।
দিদা ছুটে আসল, ‘হৃদির মাথায় অনেক জট, ও ব্যাথা পাবে। কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে।’
‘কিচ্ছু হবে না, আপনি দেখেন।’
দিদা মনে হয় বিশ্বাস করে নাই। ও পাশে দাড়িয়ে থাকল।
সাবিনা কিছু না বলে আমার মাথায় আস্তে আস্তে করে চুল আচড়াতে থাকল। এতো আরাম দিয়ে কেউ কখনো আমার চুল আঁচড়ে দেয় নাই।
‘এতো সুন্দর চুল, তোমার মায়ের মত চুল বুঝি?’
ওর কাছে মায়ের কথা শুনে খুশি হলাম। দিদা তাড়াতাড়ি বলল ‘ওর ফুপুদের চুলও খুব ঘন। ‘
‘তোমার চুলটা একটু ছেঁটে দিতে হবে, তাহলে আরও সুন্দর হবে। আর এখন থেকে আমি তোমাকে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার লাগিয়ে দেব।’
‘কন্ডিশনার কী?’
‘একটা জিনিস যেটা শ্যম্পুর পরে দিলে চুল খুব নরম, সুন্দর হয়।’
‘এই সব হাবি যাবি এতো ছোট মানুষের মাথায় দেওয়ার দরকারটা কী? ‘
দিদার এই কথায় আমার এইবার রাগ হয়ে গেল ‘আমি কন্ডিশনার দিতে চাই।’
চুল বাধা শেষ হলে আমি আর আয়নার সামনে থেকে সরতেই পারছিলাম না। কত দিন আমাদের স্কুলের মারিয়া এমনভাবে চুল বেঁধে এসেছে। আর কি আশ্চর্য সুন্দর দুটো ক্লিপ দুই পাশে। কখন যেন সাবিনা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার একবার ইচ্ছে হল ওকে জড়িয়ে ধরেতে। কিন্তু লজ্জা লাগল।
বাবা আমাকে দেখে বলল ‘আমার মাটাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে। সিন্ডারেলার মত। ‘
আমি লজ্জা পেলাম আবার।
প্যান কেকের সাথে আমি অনেক সিরাপ খাই। বাবা আগে মানা করেছে দুই একবার। আমি শুনি নাই। আমি কারো কথাই শুনি না। আজ দেখি প্যান কেকের পাশে অল্প সিরাপ। পাশে আবার এক কাপ দুধ। আমি রেগে চিৎকার করে উঠলাম ‘আরও সিরাপ দাও।’
সাবিনা আমার পাশেই বসে ছিল। আমার আরও কাছে সরে এসে বলল ‘তুমি তো প্যান কেক খেতে জানো না। প্যান কেক অল্প অল্প সিরাপ আর দুধ দিয়ে খেতে হয়।’
‘আমার কম সিরাপ মজা লাগে না আর দুধে গন্ধ লাগে।’ আমি তখনও অনেক রেগে আছি।
‘বেশি সিরাপ খেলে তোমার দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যাথা করবে। কিছুই খেতে পারবে না। টুথ ফেয়ারিও আসবে না। আর দুধের সাথে আমি চকলেট ফ্লেভার মিশিয়ে দিয়েছি, গন্ধ লাগবে না। মনে হবে চকলেট খাচ্ছ। দুধ খেলে তোমার হাড়গুলো শক্ত হবে। তুমি বাস্কেট বল খেলতে পারবে। ‘
দাঁত পড়ে গেলে আমার পচা দাঁত দেখে যদি টুথ ফেয়ারি না আসে, তাহলে তো খুব খারাপ হবে। তাছাড়া মনে হচ্ছে চকলেটের মত দুধ দিয়ে খেতে খারাপ লাগবে না। আর বাস্কেট বল খেলারও আমার অনেক ইচ্ছা।
আমি বললাম ‘ঠিক আছে, আমি একটা খাব।’
একটু পরেই বাসায় অনেক মেহমান চলে আসল। সবাই বাবার নতুন বউ দেখতে এসেছে। বাবা, দিদা সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সাবিনার সাথে কেউ কেউ কথা বলছে। কেউ কেউ আবার আমাকে কেন যেন খুব ভালো করে দেখছে। এক চাচি বলে ফেলল ‘বাহ, হাসিবের মেয়েটাকে আজ বেশ মানুষ মানুষ লাগছে। পাগলির মত চুল এলোমেলো না।’
‘মানুষ মানুষ লাগা মানে কী?’ আমি তো মানুষই। আমি বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে সরে আসলাম। আমার রুমে বসে আমি বাবার ফোনে গেম খেলছিলাম, সেখানে এসে দুজন অচেনা আনটি গল্প শুরু করল ‘ আহারে এই মেয়েটার কী হবে কে জানে? সৎ মায়ের অত্যাচারে এতোটুকু মানুষের কি হয়? খালাম্মাও নরম মানুষ। বউ নিশ্চয়ই এইবার উনাকেও বের করবে। ‘
আরেকজন বলছে ‘ খুব চালাক মেয়ে, দেখে কেউ বুঝবেই না একটা বাচ্চা নিয়ে লোককে বিয়ে করেছে। মনে হচ্ছে কত সুখী।’
‘আচ্ছা ভাবি, ওর কি আগে বিয়ে হয়েছে? নাহলে কেন এমন বিয়ে করল? তবে বয়স তো খুব কম মনে হয়। ‘
আমি ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এক ফাঁকে আমাকেও জিজ্ঞেস করেছে ‘কাল রাতে কার সাথে ঘুমিয়েছো খুকি?’
আশ্চর্য, আমার নাম কি খুকি নাকি? আমি উত্তর দেই নাই। ওদের সাথের মেয়েটা আমাকে অবাক হয়ে দেখছিল। আমি ওকে ডাকলাম আমার সাথে খেলতে। সাথে সাথে ওরা মেয়েটাকে নিয়ে গেল, যেতে যেতে বলল, ‘পাগল মায়ের মেয়ে, ওর ও তো শুনেছি কী সব সমস্যা আছে। ওর সাথে খেলা সেফ না।’
আমার ভীষণ রাগ উঠে গেল। রাগ হলে আমি চিৎকার করি, কখনো জিনিস ছুড়ি। তাই করলাম। আমার চিৎকারে দিদা ছুটে এল আর সাবিনা।
সাবিনা দিদাকে বলল ‘মা, মেহমানদের সবাইকে চা নাস্তা দেওয়া হয়েছে। ওদের খাওয়া শেষ। আপনি কি একটু যেয়ে বলবেন আমার মাথা ধরেছে? আমি একটু হৃদির সাথে থাকি। ও একা একা, মনে হয় ওর ভালো লাগছে না। ‘
‘ও তো এমনই করে মাঝে মাঝে। ‘ দিদা মন খারাপ করে বলল।
‘এখন থেকে আর করবে না। এখন তো আমি এসেছি, তাই না হৃদি?’
উত্তরে আমি কিছুই বললাম না, তখনো ঘ্যান ঘ্যান করে কেঁদে চলছি।
দিদা চলে যেতেই সাবিনা আমাকে কোলে নিয়ে নিল। ‘তুমি বন্ধু চাও না? যেই বাচ্চাগুলো এসেছে ওদের সাথে খেলতে চাও না?’
আমি রেগে রেগে বললাম ‘কিন্তু ওদের মা তো আমার সাথে খেলতে দেয় না। আমার সাথে কেউ খেলে না। স্কুলেও সবাই বলে আমার কাপড় ময়লা, আমি পড়ালেখা পারি না, তাই আমার বন্ধু হয় না।’
ও আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে ‘তুমি একটুও ভেবো না, আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দেব, তুমি সবচেয়ে বেশি পারবে সব কিছু। সবচেয়ে সুন্দর কাপড় পরে যাবে। কিন্তু তুমি চিৎকার, জিনিস ছোড়া এসব করতে পারবে না। তাহলে বাচ্চারা তোমাকে ভয় পাবে। বন্ধু হবে না।’
আমি ওর বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। আর ও আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
কখন যেন বাবা এসে ওকে ডেকে গেল ‘সবাই চলে গেছে, একটু রুমে আসো না।’
‘আসছি। তুমি একটু দেখে আসো না মা হৃদির খাওয়া রেডি করেছে কিনা। হৃদি, যাও বাবার সাথে।
‘তুমি দেখছি, এসেই বাড়ির সব্বাইকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছ, আমার কাজের পুরস্কার চাই কিন্তু।’ বলতে বলতে বাবা আমাকে নিয়ে চলে এল।
আমি ভাবছি ‘বাবাও আমার মত সাবিনার কাছ থেকে পুরস্কার পায়? আমার চেয়ে ভাল কিছু নাতো?’
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আমি আমার ছোট্ট বালিশটা নিয়ে সোজা বাবার ঘরে হাজির। লাফ মেরে বিছানায় উঠে চিৎকার শুরু করলাম ‘বাবা, ও বাবা তুমি কোথায়?’
আমার চিৎকারে বাবা ছুটে এলো ‘কী হয়েছে মা?’
‘আজ আমি আর তুমি এখানে ঘুমাব। ঘুমাতে এসো বাবা। সাবিনাকে দিদার সাথে ঘুমাতে বল।
সেকথার উত্তর না দিয়ে বাবা বলল ‘আমার তো অনেক কাজ আছে মা, কাল থেকে অফিসে যেতে হবে। আমি তো এখন ঘুমাতে পারব না।’
আমার চোখে পানি এসে গেল। বাবা আসলে আমার সাথে ঘুমাতে চাচ্ছে না। আর আমি তো একা ঘুমাতে পারি না। এদিকে ভীষণ ঘুমও পাচ্ছে।
আমাদের কথার মাঝখানে সাবিনা এসে গেল। হাতে একতা সুন্দর বই। দেখেই মনে হচ্ছে অনেক মজার মজার গল্প আছে। তাইতো, ও তো বলেছিল ও আজ আমাকে বই পড়ে শোনাবে। কিন্তু বাবার উপর অভিমানে আমার ঠোঁট ফুলে আছে, কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।
‘হৃদি মনি, চল আমরা গল্প পড়া শুরু করি। বিকেলে লাইব্রেরি থেকে এই বই নিয়ে এসেছি তোমার জন্য আমি।’
‘কিন্তু আমি আজ বাবার সাথে ঘুমাব। তুমি ঘুমাবে দিদার সঙ্গে। গল্প পড়ে তুমি চলে যাবে ঠিক আছে? ‘
সাবিনা কেন যেন হেঁসে ফেলল। ‘ঠিক আছে।’
জীবনে এই প্রথম আমি কারো কোলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনলাম। ওকে কেমন যেন মায়ের মত লাগছিল। মা কবে সুস্থ হবে আর আমাকে এভাবে ঘুম পারাবে? অসাধারণ সেই গল্প শুনতে শুনতে আমি স্বপ্নের জগতে চলে যাচ্ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
সেদিন রাতে আমি মাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম। ঘুমানোর আগে সাবিনা আমাকে ‘এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ গল্পটা পড়ে শুনাচ্ছিল, স্বপ্নে দেখলাম এলিসের সেই দেশে আমি, বাবা আর মা ছুটোছুটি করে খেলছি। আমার আসল মা।
চলবে……!!!
সাথেই থাকুন…….!!!!