Bangla StoryStory (Writer)

কমলাকান্তের সহিত তোমার কথোপকথন আমি পড়িয়াছি

কমলাকান্তের সহিত তোমার কথোপকথন আমি পড়িয়াছি

 

বিড়ালকে বলিলাম,”কমলাকান্তের সহিত তোমার কথোপকথন আমি পড়িয়াছি।”
বিড়াল একলাফে খাটে উঠিয়া বসিল।বলিল,”পড়িয়াছ,কিছু শিখিতে পার নাই।”

অবাক হইয়া বলিলাম,”তোমার পাণ্ডিত্য ভাব আদৌ কমে নাই।” বিড়াল চরণবলে আমার কম্বলখানা নিজের গায়ে টানিয়া লইল।বলিলাম,”তোমার কম্বল কোথায়?” বিড়াল শ্বাস ফেলিয়া বলিল,”আমাকে প্রথমে কে ডাকিয়াছে?কাহার ডাক শুনিয়া আমি এখানে আসিয়া বসিয়াছি?” থতমত খাইলাম,প্রকাশ করিলাম না।বলিলাম,”ভাল করিয়া ঢুকিয়া বস,ঠাণ্ডা পরিতেছে।” বিড়াল নরম হইল।বলিল,”খাইবার কী আছে?” বলিলাম,”তুমি একটু আগেই রাত্রিভোজন সম্পন্ন করিয়াছ।নিজে গিয়া তোমাকে খাবার পরিবেশন করিয়াছি।” উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হইয়া বিড়াল চোখ তুলিয়া নিরীহ দৃষ্টিতে তাকাইল একবার,আমাকে বুঝিতে না দিয়া বলিল,”বুঝিয়াছি।” আমি সতর্কতা অবলম্বন করিয়া চাপা কণ্ঠে বলিলাম,”কী বুঝিয়াছি?”

বিড়াল সন্তর্পণে মাথার অর্ধেকখানা কম্বলের ভিতরে ঢুকাইয়া বলিল,”কমলাকান্ত পড়িয়াছ?” বলিলাম,”হু,পড়িয়াছি।” “পরীক্ষার জন্যে পড়িয়াছ,শিখিবার জন্যে পড় নাই।” বলিলাম,”এইসব তুমি বুঝিবেনা,পরীক্ষা ব্যতীত জীবন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নহে।” বিড়াল রাগ করিল।মুখ ভ্যাঁংচাইয়া বলিল,”পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য কী?যাহা পড় তাহা হইতে কিছু শিখিয়া বাস্তবে তাহার প্রতিফলন করা,নহে কি?” আমি বুঝিতে পারিলাম সে কী বলিতে চাইতেছে।বলিলাম,তোমার উপদেশবাক্য কী হইতে পারে আমি বুঝিয়া গিয়াছি।শুনিয়া লও,বর্তমান সমাজে এতসব মহামূল্যবান কথা একেবারেই মূল্যহীন।আমি পড়িব,পড়িয়া পরীক্ষা দিব,যদি পাশ করি,তবে সার্টিফিকেট পাইব,আর সেই সার্টিফিকেট আমাকে চাকুরী আনিয়া দিবে,তাহাতেই আমার উদরের শান্তি।”

বিড়াল এদিক ওদিক চাহিয়া থুথু ফেলিল।বলিল,”আত্মার শান্তি না থাকিলে উদরের শান্তি দিয়া কী করিবা?” স্তম্ভিত হইলাম।এ বেটা শুরু করিয়াছে।করুক,আমি কমলাকান্ত নহে,আফিং খাইনা,সুতরাং বিড়াল আমার মাথা খাইতে পারিবেনা।চট করিয়া মাথায় বুদ্ধি আসিয়া গেল।জোর দিয়া বলিলাম,”অদ্য তুমি আমাকে প্রশ্ন করিতেছ উদরের শান্তি দিয়া কী করিব?অথচ সেইদিন কমলাকান্তের সহিত তোমার তর্কের আলোচ্য বিষয় কী আছিল? তুমি কি উদরের শান্তির জন্যই তর্ক কর নাই?” ধমক দিয়া বিড়াল বলিল,” পাগলের মতো কথা বলিওনা।আমি বিড়াল,উদরের শান্তি হইলেই আমার আত্মার শান্তি ঘটে।তুমি মনুষ্য,উদরপুর্তিতেই তোমার আত্মার শান্তি আসিতে পারেনা।আমি বিশ্বাস করিনা।” বিড়ালের কথা শুনিয়া হোঁচট খাইলাম।হাতের বাংলাবইখানা ফেলিয়া স্বীয়পক্ষ টানিয়া বলিলাম,”আত্মার শান্তি দিয়া কী করিব,যদি উদর শান্তির অভাবে মরিয়া ভুত হইয়া যায়?” বিড়াল বলিল,”তোমরা মনুষ্য,ভাতের অভাবে তোমাদিগের মরণ হইবেনা,হইলেও আত্মাকে সমৃদ্ধ কর,দেখিবে ভাত নিজেই তোমার কাছে আসিয়া যাইবে,তোমাকে ভাতের কাছে যাইতে হইবেনা।”

আমি চুপ মারিয়া গেলাম।এই বেটা হার মানিবার মত নহে।তথাপি উপর্যুক্ত যুক্তি দেখাইয়া বলিলাম,”সে এক,দুই বেলা।বাকি জীবন কী খাইব?” বিড়াল কম্বলের তল হইতে বাহির হইয়া আসিল।চোক্ষু দিকে তাকাইয়া বলিল,”পরীক্ষায় পাশ করিয়া কী করিবা যদি মানুষ হইতে না পার?” সন্তর্পণে বলিলাম,”দেখ,উদরকে শান্তি আনিয়া দিবে চাকুরি,চাকুরি আনিয়া দিবে সার্টিফিকেট,সার্টিফিকেটকে আনিয়া দিবে পরীক্ষা।অতএব পরীক্ষায় পাশ করা একান্ত কর্তব্য।” বিড়াল বলিল,ওহো!আর আত্মার সমৃদ্ধি দরকার নাই?শুনো,পরীক্ষায় পাশ করিবা,বাধা দিবনা।তাই বলিয়া মানুষ হইবা না,এইটা হয় নাকি?” ভাবিয়া বলিলাম,”কী বলিতে চাইতেছ?” বিড়াল বলিল,”আমি আসিয়া তোমার কাছে খাবার চাইলাম,তুমি অপমান করিলা।তাহা হইলে কমলাকান্ত পড়িয়া কী শিখিলা?কেবলই পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য কমলাকান্ত পড়িয়াছ,এখন পরীক্ষা সমাপ্ত হইয়াছে,তাই কমলাকান্তও হজম হইয়া গিয়াছে,তাহাই তো?” বলিলাম,”পরীক্ষায় পাশ করিয়া চাকুরি করিব,প্রাপ্ত অর্থ দিয়া তোমার সেবা করিব।” বলিলাম,”সেবা করিতেও অর্থ দরকার।অর্থ না থাকিলে তোমাকে কী দিয়া খাওয়াইব?”

বিড়াল দাঁত বাহির করিয়া দিল।একটু অপমান বোধ করিলাম।সে বলিল,”এখন পড়ালেখা করিব পাশের জন্য,পাশ করিয়া পরকল্যাণ করিব,এইসব আফিঙখোররাই বলিয়া বেড়ায়,তুমি তো আফিং খাও না।তুমি পাশ করিয়া অপরের সেবা করিবা,আর এখন বেহায়ার মত বই মুখস্থ করিবা,তাহার মানে কী বলিতে চাও? তুমি পাশ না হওয়া অবদি যাহার যা খুশি হোক,মরুক,তাহাতে তোমার কী,তাহাই তো?” কমলাকান্ত মার্জারকে কেন সুতার্কিক বলিয়াছিলেন বুঝিতে পারিয়াছি।নিঃশ্বাস নিয়া বলিলাম,”পাশ করিলে অর্থ হইবে,সকলের দুখ ভুলাইব।” বিড়াল বলিল,”স্বার্থ!স্বার্থ!ইহাও স্বার্থ।” বলিলাম,”কী বলিতেছ?” সে বলিল,”তুমি পাশ করিয়া সকলের দুখ ভুলাইবা,তাহাতে লোকে তোমাকে বাহাবা দিবে,তুমি খুশিতে লম্ফ মারিবা।স্বার্থ বৈকী!” বিড়াল বলিল,”পরের কল্যাণে যাহারা ব্রতী,তাহারা জীবনের শুরু হইতে পরোপকার করে।পাশের অপেক্ষায় থাকেনা।” বলিলাম,”তোমার কাছে মনে হইতে পারে,কিন্তু….!” “তর্ক করিয়ো না,” বিড়াল বলিল।

“পড়ালেখা করিতেছ কর,পাশও কর,আপত্তি নাই।কিন্তু ‘পাশ করা’ পড়ালেখার উদ্দেশ্য রাখিওনা।যাহা শিখিতেছ তাহা বাস্তবে প্রয়োগ কর,অপরের কল্যাণ কর।মানিয়া লইলাম এইসব করিতে তোমার পড়ার ক্ষতি হইবে,সময় নষ্ট হইবে,তুমি ইঞ্জিনিয়ার হইতে পারিবা না।তথাপি মনে রাখিও,ইঞ্জিনিয়ার হয়তো হইতে পারিবা না,কিন্তু যাহারা তোমার সেবা পাইবে,তাহারা তোমারে ইঞ্জিনিয়ারেরও উপরে লইয়া যাইবে।আর অপরের সেবা করিলে,অপরকে ভালোবাসিলে তুমি যে ভাতের অভাবে মরিবানা,সেই ভরসা আমি দিলাম।”

চিন্তা করিয়া বলিলাম,”বড়বড় বহু কবি,সাহিত্যিক,দার্শনিক,মহাগুরু তোমার মত জ্ঞান দিয়া গেছে বইপুস্তকে,কিন্তু যুগ পাল্টিয়া গিয়াছে,সার্টিফিকেট না থাকিলে চাকুরি মিলে না।” বিড়াল বলিল,”মিলিবে কীভাবে?তোমারে বুঝাইতে আমার এত কষ্ট,বাকি শতশ কোটি মানুষেরে কে বুঝাইবে?” আনন্দে মুখ বড় করিয়া বলিলাম,”তাহা হইলে তুমিই বল,আমার কী করিবার আছে?” বিড়াল বলিল,”এই প্রশ্ন করিয়ো না।বাকিদিগের কথা ভুলিয়া যাও,তাহারা ভুল পথে যাক,তুমি অদ্য হইতে আত্মার দেখানো পথে চলো।মিথ্যা ত্যাগ কর,অপরকে ভালবাস,অপরের বিপদে আগাইয়া যাও,ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর,বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান কর,রাস্তার মানুষকে ঘরে তুলিয়া লও।পড়ালেখার পাশাপাশি এইসব কর।আত্মাও সমৃদ্ধ হইবে,পাশও হইবে।” আমার জিদ হইল।বলিলাম,”অসম্ভব!দলের একশজন যেদিকে যাইবে আমি তাহার বিপরীতে যাইতে পারিবনা,মারা পড়িব।” বিড়াল রাগ করিয়া বলিল,”কেন মারা পড়িবা?তোমারে দেখিয়া দশজন শিখিবে,দশজনকে দেখিয়া একশজন শিখিবে।মারা পড়িবা না,মহৎ হইবা।” বিড়ালকে বলিলাম,”বাস্তবে এমনটা হইবেনা।প্রচলিত ধারার পরিবর্তন দুঃসাধ্য।” বিড়াল আবার বলিল,”তোমরা মনুষ্য জাতি এইরকমই!দুঃসাধ্য বলিয়া পরিবর্তন আনিবার চেষ্টা না করিলে পরিবর্তন আসিবে কীভাবে?তোমাদিগকে শিখাইয়া লাভ নাই,তোমরা আমল কর না,সার্টিফিকেট তোমাদিগের মাথা খাইয়াছে।বাদ দাও!ক্ষুধা পাইয়াছে,কী করিব?”

বিছানা ছাড়িয়া পাকের ঘরে দৌড় দিয়া গেলাম।পরদিবস প্রাতে খাইবার নিমিত্তে সুকন্যা মাংস রন্ধন করিয়া গিয়াছে।তাহা হইতে তিন পিস আনিয়া বিড়ালের উদরপুর্তির ব্যবস্থা করিলাম।

ম্যাও করিয়া ধন্যবাদ জানাইয়া মার্জার আত্মবাসস্থানে রাত্রিযাপনে চলিয়া গেল।আমি বড় করিয়া নিঃশ্বাস নিলাম।কী বলিয়া গেল এইসব???বুঝিলাম,কমলাকান্ত মনের সুখে আফিংখোর হন নাই।মাথা আমারও ঘুরিতেছে।অদ্য আর পড়া হইবেনা।বইখানা বন্ধ করিয়া রাখিয়া কম্বলে গা ঢাকা দিলাম পরোপকারের সংজ্ঞা মুখস্থ করিতে করিতে,পরীক্ষায় আসিতে পারে।

—-সমাপ্ত—-

লেখা:এলমুন নূর খান

Shakil Ahmed

I'm a Content writer. My topic is Tech, Story, SEO, Digital Marketing etc. I'm Work With MDOmarMakki.Org Website for CEO of This Website MD Omar Makki

Related Articles

Back to top button
error: Alert: Content is protected !!